মিঠে কড়া সংলাপ
উচিত কথা না বলাটাও দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অনেক সময়ই আমরা উচিত কথাটি বলতে পারি না। কারণ উচিত কথায় বেজার হওয়া লোকজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ও শক্তিশালী। তবে ইদানীং কেউ কেউ আবার উচিত কথা বলে হাটে হাঁড়িও ভেঙে দিচ্ছেন। যেমন কিছু দিন আগে যুগান্তরের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘মন্ত্রীদের ভেতর একটা সিন্ডিকেট আছে। সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, খেলাপি ঋণসহ নানা বিষয় তুলে ধরে তিনি আরও বলেছেন, সব কথা বলতে গেলে দেখবেন আমার লাশটা রাস্তায় পড়ে আছে।’
আবার গত মঙ্গলবার সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশনে একজন সংসদ-সদস্য বলেছেন, ‘এমন কোনো দপ্তর নেই যেখানে ঘুস খাওয়া হয় না। আগে মানুষ মনে করত একটি বিশেষ বাহিনী ঘুস খায়, আর এখন এমন কোনো দপ্তর নেই যেখানে ঘুস খাওয়া হয় না। আর যারা ঘুস খান না, তারা সংখ্যালঘু এবং তাদের তেমন কোনো কাজও নেই। এখন বড় বড় রাঘববোয়াল টাকা বা ডলারে ঘুস খান না; তারা এখন সোনার বার ঘুস হিসাবে নেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সব জায়গায় সিন্ডিকেট করে ওই কর্মকর্তারা দুর্নীতি করেন; টাকা না দিলে কাজ হয় না; মাসের পর মাস ঘুরতে হয়; অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাদের পাওয়া যায় না, যারা বিদেশে টাকা পাচার করে বেগম পাড়ায় বাড়ি করেছেন।’ তাদের শতকরা ৯০ জন আমলা বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
এ অবস্থায় একজন প্রতিমন্ত্রী এবং সংসদ-সদস্যের কথায় প্রমাণিত হয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুস-দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে বিধায় কিছু কিছু সত্য কথা তাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। যুগান্তরের মতো একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে এবং জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে দাঁড়িয়ে এমন সত্য ভাষণের জন্য আমরা তাদের সাধুবাদ জানিয়ে সরকারি উচ্চ মহলের উদ্দেশে বলতে চাই, তাদের এসব কথার যেন মূল্যায়ন করা হয়। অন্যথায় সংসদে দাঁড়িয়ে একজন সংসদ-সদস্যের বক্তব্যও যদি অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়, তাহলে জাতীয় সংসদের মতো একটি মহান প্রতিষ্ঠানও মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
কারণ ইতঃপূর্বেও আমরা দেখেছি যে, মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সরকারদলীয় একজন সংসদ-সদস্য দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলছেন, ‘সরকারি অফিসের একজন পিয়নও তাদের পাত্তা দেয় না।’ আর সে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেছে বলেও মনে হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি আমলারা যে যার ইচ্ছামতো চলাফেরা এবং কাজকর্ম করে চলেছেন; ফলে অনেক অফিস আদালতেই জনসাধারণকে নিগৃহীত হতে হচ্ছে। আমার দেখামতে, ডাক্তার দেখিয়ে বিদেশ থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিমানবন্দরে বৃদ্ধ এক দম্পতিকে শত শত যাত্রীর ভিড়ের একই লাইনে ঢুকিয়ে দিলে ভ্রমণক্লান্ত দম্পতি গ্রিন চ্যানেল দিয়ে যেতে চেয়ে গ্রিন চ্যানেল খোঁজ করতে এগিয়ে আসায় তাদের অপমান করে আবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত শত শত যাত্রীর ভেতর ঠেলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সে অবস্থায় আগত যাত্রীদের জন্য কোনো গ্রিন চ্যানেল না থাকার বিষয়টি জানতে চেয়ে এবং অসুস্থতা ও দুর্বলতার কারণে তাদের পক্ষে স্ক্যানিং মেশিনে লাগেজ উঠানো সম্ভব নয়, কথাটি বলার পর ধমক দিয়ে আইনে সোপর্দ করার ভয় দেখিয়ে বৃদ্ধ দম্পতিকে সাধারণ লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে তাদের নিজ হাতে স্ক্যানিং মেশিনে মাল উঠিয়ে দিতে বাধ্য করে লাগেজ দুটিতে কোনো শুল্কায়নযোগ্য মালামাল না পেয়ে অবশেষে কাস্টমস কর্মকর্তারা তাদের মুক্তি প্রদান করেন।
আর এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, বিমান প্রতিমন্ত্রীর বড় গলায় বলা ‘শুল্কায়নযোগ্য মালামাল না থাকা যাত্রীদের গ্রিন চ্যানেল দিয়ে ঢোকার/আসার বিষয়টিও মাঠে মারা গেল! কারণ সেখানে তো কোনো গ্রিন চ্যানেলই পাওয়া গেল না! বিমান প্রতিমন্ত্রীর ঘোষিত গ্রিন চ্যানেল খুঁজতে যাওয়া বৃদ্ধ দম্পতিকে সেদিন কীভাবেই না নাস্তানাবুদ করা হলো; অপমান করা হলো! আর এসব ঘটনার পরও বিমান প্রতিমন্ত্রী কি বলবেন যে, বিমানবন্দর তার কথায় বা তার নিজের বা নিজেদের তৈরি করা আইনকানুন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। আসল কথা হলো, মোটেও তা নয়; বিমানবন্দরও পরিচালিত হচ্ছে সেখানকার একশ্রেণির ধান্ধাবাজ কর্মকর্তা, কর্মচারীর মর্জিমাফিক।
উদাহরণ দিলে আরও অনেক অফিস-আদালতের গণবিরোধী কার্যকলাপের কথা এখানে উল্লেখ করা যাবে। আমার মনে হয় তার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে একজন প্রতিমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একজন সংসদ-সদস্য সব কিছুই বলে দিয়েছেন। এখানে আমি শুধু বলতে চাই বা জানতে চাই, বিমানবন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করা হয় কী করে! এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে ই-পাসপোর্টধারী ব্যক্তিদের বহির্গমনের ক্ষেত্রে যে সহজ পদ্ধতির কথা বলেছিলেন, তা প্রতিপালিত হচ্ছে, নাকি নিরীহ যাত্রীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ, টানাহেঁছড়া করে সময় নষ্ট তথা হয়রানি করা হচ্ছে সে বিষয়টিও বোধহয় তিনি জানেন না। আর তিনি তা না জেনে থাকলে গোয়েন্দা তদারকির মাধ্যমে বিষয়টি জানার জন্য তার প্রতিও অনুরোধ রইল।
কারণ এখানে এ কথাটিও বলে রাখা হলো যে, মুখচেনা ব্যক্তি বা তথাকথিত ভিআইপি ছাড়া সাধারণ, নিরীহ, ভদ্রলোকের ক্ষেত্রে বিমানবন্দরের ভোগান্তি কিন্তু একটুও কমেনি। এ অবস্থায় শিল্প প্রতিমন্ত্রী মহোদয় পত্রিকার সাক্ষাৎকারে এবং এমপি মহোদয় সংসদে দাঁড়িয়ে বোধহয় এসব অনিয়ম, অসংগতি, দুর্নীতির কথাই বলতে চেয়েছেন। বিভিন্ন অফিস-আদালতে ঘুস, দুর্নীতি জেঁকে বসেছে বলেই তারা ভিন্ন স্থানে, ভিন্নভাবে কথাগুলো বলে ফেলেছেন। এখন এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হবে কিনা, একমাত্র সরকারি হাইকমান্ডই তা বলতে পারবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বেশ দৃঢ়ভাবে দেশের শাসনভার পরিচালনা করলেও দুর্নীতিবাজ আমলা কর্মচারীদের অপতৎপরতা থেকে দেশের সাধারণ মানুষকে কেন রক্ষা করা যাচ্ছে না সে বিষয়টি এখন ‘জ্বলন্ত প্রশ্ন’ হিসাবে জনসাধারণের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। কারণ বর্তমান অবস্থায় এক শ্রেণির সরকারি আমলা কর্মচারী অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে জনসাধারণের ঘাড়ে চেপে বসে সরকারি দায়িত্ব কর্তব্য পালনের নামে নিজেদের আখের গুছিয়ে চলেছেন।
বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসে চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে মুদ্রা পাচারে সহায়তা করাসহ যোগসাজশের মাধ্যমে বেশির ভাগ চোরাচালানি মালামাল ছেড়ে দিচ্ছেন, আবার লোক দেখানো দু’একজন ছিঁচকে চোরাচালানিকে ধরে বড় বড় চোরাচালানকে জায়েজ করে ফেলছেন! অন্যথায় পি কে হালদারসহ অন্যরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করতে পারত না; আর শ্রমজীবী মানুষের ঘাম ঝরানো বৈদেশিক মুদ্রাও এভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যেত না!
আমার দেশের সন্তানেরা পোশাকশিল্পে কম বেতনে শ্রম দিয়ে, মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে কম পারিশ্রমিকে রোদে পুড়ে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন, তার বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়ে না গেলে দেশে আজ বৈদেশিক মুদ্রারও ঘাটতি হতো না। আর এসব পাচারকার্যে যে বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে কমর্রত একশ্রেণির কাস্টমস কর্মকর্তাসহ ইমিগ্রেশন বিভাগের কেউ কেউ জড়িত সে কথাটি বলাই বাহুল্য।
এই তো মাত্র ক’দিন আগেও দুদকের চার্জশিটভুক্ত ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকা একজন রাঘববোয়াল সহায়সম্পত্তি বিক্রি করে দিব্যি কানাডা পালিয়ে গেছেন বলে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে! অথচ একজন সাধারণ নিরীহ যাত্রী বা বিদেশে শ্রম দিতে যাওয়া একজন শ্রমিককে বিদেশ যাওয়ার সময় জিজ্ঞাসাবাদ করে নাস্তানাবুদ করা হয়। আর স্বাধীনতার পর থেকেই এসব অপকর্ম অব্যাহত আছে। কখনো কম, কখনো বেশি, পার্থক্য শুধু এটুকুই।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর দেশ গঠনে আত্মনিয়োগকারী বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিপদে ফেলতে তখনো একদল মানুষ ঘুস, দুর্নীতি, লুটপাট, চোরাচালানির মাধ্যমে দেশের ক্ষতিসাধন করায় বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষের জন্য বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমি যা নিয়ে আসি, চাটার দল তা সব চেটেপুটে খেয়ে ফেলে...।’ আর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বর্তমান শাসন আমলেও একই ঘটনা ঘটে চলেছে; বর্তমানেও আমাদের বৈদেশিক ঋণের অর্থ, শ্রমিকের শ্রমলব্ধ কষ্টার্জিত অর্থ একইভাবে লোপাট করা হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে লোপাটের কিছুটা রকমফের হয়েছে মাত্র।
একশ্রেণির লোক টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্থ কামিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন, সরকারি আমলা কর্মচারীদের যোগসাজশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অর্থ লোপাট করে ধরা পড়ার ভয়ে তা দেশে না রেখে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন; বিভিন্ন কোম্পানি খুলে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তাদের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছেন; দেশের পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে কোনো কোনো কোম্পানি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশ পর্যন্ত বিতরণ না করে সেসব অর্থ রিজার্ভ ফান্ডে জমা রেখে পরবর্তীকালে নিজেদের এবং পরিবারের আরাম-আয়েশের জন্য বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। আর বিদ্যুৎ খাতের এমন একটি কোম্পানির মালিকরা এভাবে এসব অর্থ সিঙ্গাপুরে নিয়ে গিয়ে সেখানে ব্যবসা করে প্রচুর পরিমাণ আয়কর দিয়ে সে দেশের নাগরিকও হয়েছেন।
তাছাড়া আরও দু’একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নামেও পুঁজিবাজারের অর্থ লোপাট করাসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করার অভিযোগ আছে। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো, তাদের নাম নিয়ে কিছু বলা যাবে না; কিছু লেখা যাবে না। আর তার কারণ হিসাবে শিল্প প্রতিমন্ত্রী তার সাক্ষাৎকারে বলেই ফেলেছেন, ‘সব কথা বলতে গেলে দেখবেন আমার লাশটা রাস্তায় পড়ে আছে।’
কিন্তু তাই বলে কেউ কোনো দিন কোনো কথাই বলবেন না বা বলতে পারবেন না, তেমনটিও কিন্তু নয়। যেমন শিল্প প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ও না বলতে বলতে অনেক কথাই বলে দিয়েছেন। আবার বাজেট অধিবেশনে এমপি মহোদয়ও কম কিছু বলেননি। এখন সরকারি হাইকমান্ড এসব কথা কানে তুললেই হয়। যদিও তাদের এসব কথা বলা এবং এসব নিয়ে আমাদের লেখালেখি সবকিছু বৃথা যাবে, ব্যর্থ হয়ে যাবে এমনটিও নয়।
কারণ চোখের সামনে মুষ্টিবদ্ধ হাত রাখলে দুনিয়াটা অন্ধকার দেখালে বা যে কেউ অন্ধ হয়ে থাকলেও কিন্তু প্রলয় থেমে থাকে না। এক্ষেত্রে শিল্প প্রতিমন্ত্রী এবং এমপি সাহেব তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং আমার লেখনিতেও কিছু বিষয় সরাসরি এবং কিছু বিষয় আভাস ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছি। সবকিছু দেখেশুনে কোনো কিছু না বলাটাও একটি অপরাধ বলেই এসব বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কারণ স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী একটি দল ক্ষমতায় থাকাবস্থায় স্বার্থান্বেষী মহল তাদের আখের গোছাতে দেশ ও জাতির ক্ষতি করবে আর আমরা সবাই বসে বসে তা দেখব, সেটি হতে পারে না। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, অনেক সময় উচিত কথা না বলাটাও দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট