স্বদেশ ভাবনা
সংলাপ নিয়ে ধোঁয়াশা আর নয়
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির যখন দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান, অর্থাৎ যখন আওয়ামী লীগ বলছে সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই আগামী সংসদ নির্বাচন হবে, আর বিএনপি বলছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে, তখন ৬ জুন রাজধানীতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের এক জনসভায় জোটের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে।
বিএনপি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে না নিলেও আমির হোসেন আমুর বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় বিভিন্ন মহল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সমস্যা সমাধানে সংলাপের পক্ষে কথা বলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ আমির হোসেন আমুর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বক্তব্য দেন। বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে আওয়ামী লীগ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আর আমির হোসেন আমুর বক্তব্যটি তার ব্যক্তিগত বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমু তার অবস্থান থেকে সরে গিয়ে বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে কাউকে আলোচনার জন্য আহ্বান করা হয়নি। এদিকে ৯ জুন রাতে গণভবনের গেটে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের আপাতত সংলাপের কোনো ভাবনা নেই। তবে সংলাপের আশার প্রদীপ এখনো নিভে যায়নি’ (যুগান্তর, ১০ জুন)। প্রশ্ন উঠতে পারে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে যখন আলোচনার টেবিলে বসানোর দাবি দেশি-বিদেশি সব মহলের, তখন সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রীরা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে সংলাপ নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছেন কেন?
এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে বা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ নিবন্ধিত অন্যসব দলের মধ্যে সংলাপ হলেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে। কারণ, আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের উদাহরণ খুবই কম। আমাদের স্মরণে আছে, বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মাগুরার একটি আসনে উপনির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। অন্য দুটি দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীও একই দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগ প্রথমে সংসদ বর্জন ও পরে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। দীর্ঘ সহিংস আন্দোলনে দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ায় জনগণ চরম বিপদের সম্মুখীন হয়, শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় লাখ লাখ শিক্ষার্থী, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্য। অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এ সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসানে মধ্যস্থতা করতে ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকায় আসেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান মার্টিন স্টিফেন। তিনি উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনেন এবং সমঝোতার লক্ষ্যে একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেন। খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর (খালেদা জিয়ার) নেতৃত্বে ৪৫ দিনের জন্য একটি নির্দলীয় সরকার গঠিত হবে এবং ১০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী মনোনীত চারজন এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী মনোনীত পাঁচজন সদস্য থাকবেন। নিনিয়ানের এ প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন বিএনপি সম্মতি জানালেও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানিয়ে দেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য কোনো ফর্মুলা তিনি মানবেন না। ব্যর্থ হয় নিনিয়ান মিশন।
জাতিসংঘ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের লক্ষ্যে মধ্যস্থতা করতে ঢাকায় দূত পাঠায় ২০১৩ সালে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর দু’বছর পার হতে না হতেই আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি সরকার প্রবর্তিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। উল্লেখ্য, তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সরকার সংবিধান সংশোধন করে ১৯৯৬ সালের মার্চে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আন্দোলন শুরু করে। অনিবার্য হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সংঘাত। এ পরিস্থিতি অবসানে মধ্যস্থতা করতে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (জানুয়ারি ২০১৪) আগেই জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে ঢাকায় প্রেরণ করেন। অনেক চেষ্টা করেও তারানকো আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কোনো সমঝোতার জায়গায় আনতে পারেননি। ব্যর্থ হয় তারানকো মিশনও।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে অর্থাৎ নভেম্বরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, গণফোরাম, জাসদের একাংশ এবং নাগরিক ঐক্য নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির মধ্যে ছিল খালেদা জিয়ার মুক্তি, সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন। বৈঠক সফল হয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচন-পূর্ব অবস্থা সরকারবিরোধীদের অংশগ্রহণের জন্য মোটেই অনুকূল ছিল না। হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের আটক করা হয়। তাদের নির্বাচনি প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়। নির্বাচনি বিধিবিধান প্রতিপালনে পক্ষপাতিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এসব সত্ত্বেও নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমন আশ্বাসে বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী দল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু নির্বাচন মোটেই অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। এ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ছিল-নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্ধারিত দিনের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ব্যালট বাক্সে ভোট প্রদান। এ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
আলোচনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের নজির যে নেই তা নয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতির স্থলে একদলীয় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেও রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা থেকেই যায়। রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদও রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল রাখেন। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গণআন্দোলনের মুখে এইচএম এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সরকার ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে (১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। রাষ্ট্রপতি সরকারব্যবস্থা চালু থাকবে, নাকি মূল সংবিধানের সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু রাখা হবে, তা একটি ইস্যু হয়ে দেখা দেয়। মূলত ক্ষমতাসীন বিএনপি ও প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য হয় এবং ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা কার্যকর করা হয়। সরকারি দায়িত্ব পালনে বিলটি পাশের দিনে জাতীয় সংসদ ভবনে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। বিলটি পাশের পর সেদিন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্যদের একে অপরকে আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব আনন্দময় দৃশ্যের।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়ম সংগঠিত হওয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। এ নির্বাচনে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি কোনো দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বর্তমানে বিএনপিসহ দুই ডজনের বেশি সরকারবিরোধী দল ও জোট নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আন্দোলন করছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে আজ এমন সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তাই নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নির্ধারণে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ সরকারবিরোধী সব দল ও জোটকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। সংলাপ নিয়ে সরকারি দলের আর ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা উচিত নয়। বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। বাইরের কারও মধ্যস্থতা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হোক এ সংলাপ। দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সবাই দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে খোলা মন নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসলে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে জনগণের বিশ্বাস।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com