Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

এ বাজেট খাদ্যশস্যের উৎপাদনে ব্যয় বাড়াবে

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ বাজেট খাদ্যশস্যের উৎপাদনে ব্যয় বাড়াবে

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন।

চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) সংশোধিত বাজেটের (৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি) তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বেড়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটকে জনবান্ধব আখ্যা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট। এদিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নিত্যপণ্যের দামের যে ঊর্ধ্বগতি, চলমান যে সংকট সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো রূপরেখা বাজেটে নেই। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে জনবান্ধব বা কল্যাণমুখী বলে কিছু নেই।

সিপিবি বলেছে, বাজেটে দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্তির নির্দেশনা নেই; বরং জনগণের কাঁধে নানাভাবে করের বোঝা চাপবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলবে। গণসংহতি আন্দোলনের মতে, প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কোনো দিকনির্দেশনা নেই। গণফোরাম প্রস্তাবিত বাজেটকে সিন্ডিকেটের বাজেট বলে আখ্যায়িত করেছে। মহামারি করোনার সুদূরপ্রসারী অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট সংকটের মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় অর্থনীতি ধরে রাখার প্রচেষ্টা বলে মনে করে জাসদ (ইনু)। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন মনে করেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ১১৯টি আইটেমের ওপর রেগুলেটরি ট্যাক্স আরোপ করায় স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা কমে যাবে।

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে দ্য চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, এ বাজেট স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক হবে। পাশাপাশি আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে দেশীয় শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও বিনিয়োগ সূচকের ক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার তেমন মিল নেই। দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় লক্ষ্যগুলো বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। অনুমিতি বা প্রক্ষেপণের দুর্বলতার কারণে পরে বাজেট বাস্তবায়ন হোঁচট খাবে। তাতে শেষ পর্যন্ত হয়তো লক্ষ্য বাস্তবায়নও হবে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, চলমান অর্থনৈতিক সংকট, ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার মূল কারণ দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের মতো ঘটনাকে প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী একেবারেই স্বীকার করেননি। একইভাবে সুশাসন ও ন্যায্যতার ভাবনাকেও উল্লেখ করা হয়নি। অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রস্তাবিত বাজেট জনগণের সুরক্ষা না দিয়ে বরং দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়াবে; সাধারণ মানুষের জন্য কোনো স্বস্তি বয়ে আনবে না।

উপরের মতামতগুলোর মাধ্যমে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, আগামীতে আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে পার হতে যাচ্ছি। প্রস্তাবিত বাজেট কীভাবে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

খাদ্যের একাধিক উপাদান থাকলেও বাংলাদেশে খাদ্য বলতে মূলত প্রধান খাদ্যশস্য চাল থেকে তৈরি ভাতকে বোঝায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় চালের উৎপাদনশীলতা তথা উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার কম। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ‘৫০ ইয়ার্স অব রাইস ব্রিডিং ইন বাংলাদেশ : জেনেটিক ইল্ড ট্রেন্ডস’ এবং ‘রাইস ভিশন ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক দুটি গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, চালের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বার্ষিক হার যখন দশমিক ৮২ শতাংশ, তখন এপ্রিলে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২১’ অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭ শতাংশ। ফলে দেশে উৎপাদিত চাল চাহিদা মেটাতে পারছে না। আমাদের চালের উৎপাদনশীলতা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীনের তুলনায় কম হওয়ায় চাল উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় বাড়ছে। কৃষকের চাল উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে সরকার কর্তৃক সার এবং জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও গত ১০ মাসে দুই দফায় সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের আগস্টে ইউরিয়া সারের দাম কৃষক পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৬ টাকা বাড়িয়ে ১৬ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এপ্রিলে আরেক দফা দাম বাড়ানো হয়। এ সময় ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি-এ চার ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়ানো হয়। সারের এ পুনর্নির্ধারিত মূল্য ইতোমধ্যে কৃষকের চাল উৎপাদন ব্যয় অনেকটা বৃদ্ধি করেছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তিন ধরনের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এর মধ্যে রয়েছে-গুণগতমান উন্নয়নসংক্রান্ত শর্ত, অবকাঠামোগত মানোন্নয়ন এবং সাধারণ শর্ত। তিন খাতে ছোট-বড় সব মিলে শর্তের সংখ্যা ৩০। সাধারণ শর্তের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো (যুগান্তর, ৪ জুন)। তাই আইএমএফ’র সাধারণ শর্তের আওতায় সরকার আগামী অর্থবছরে সারের দাম আরও বাড়াতে পারে। আগস্টে ডিজেলের দাম ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রতি লিটারের দাম ১১৪ টাকা করা হয়। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ করে তিন দফায় মোট ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সরকার সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ হারে রেয়াত দিলেও ক্রমান্বয়ে বাড়ানো বিদ্যুতের দামে কৃষক অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আইএমএফ’র সাধারণ শর্তের আওতায় আগামী অর্থবছর জ্বালানি-বিদ্যুতের দাম আরও বাড়তে পারে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধি কৃষকের ধান উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে। এদিকে খোদ প্রধানমন্ত্রী গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ৫ ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত ‘বিনিয়োগ ভবন’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ সাপ্লাই দেওয়া যাবে; যদি সবাই ক্রয়মূল্য যা হবে সেটা দিতে রাজি থাকে, তাহলে দেওয়া যাবে। তাছাড়া আর কত ভর্তুকি দেওয়া যায়?’

প্রধান খাদ্যশস্য চালের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে চাল ক্রেতার ওপর। বড় ও মাঝারি শ্রেণির কমবেশি ২০ শতাংশ কৃষক ছাড়া দেশের বাকি ৮০ শতাংশ মানুষ চাল কিনে খান। ধান উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের বেশিরভাগ ধান কাটা-মাড়াই মৌসুম শেষের কিছুদিন পর চালের ক্রেতায় পরিণত হন। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, গত এক বছরে দেশের কমবেশি ৭০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৭.৯৫ শতাংশ। আর নাজিরশাইলসহ সরু চালের দাম বেড়েছে ২০.২৯ শতাংশ। আগামীতে সার, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়লে বৃদ্ধি পাবে চালের উৎপাদন খরচ, যা বাজারে পণ্যটির দাম আরও বাড়াবে। এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, গরিব ও অতিগরিবদের দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়বে। গরিব ও অতিগরিবদের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দ কিছুটা বাড়ালেও একইসঙ্গে বাড়িয়েছে উপকারভোগীর সংখ্যা। এতে উপকারভোগীদের বর্তমান দুর্দশার কোনো পরিবর্তন হবে না। তাই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি দেশে দারিদ্র্য হার হ্রাসে তেমন অবদান রাখতে পারছে না। তাছাড়া চালের দাম আরও বাড়লে মধ্যবিত্তরা আমিষ জাতীয় খাদ্য-মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি কেনা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাবে। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে।

খাদ্যশস্যের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গম উৎপাদনে প্রবৃদ্ধিহার পুরোপুরি নেতিবাচক। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের উৎপাদন ১৯.৮ লাখ টন বর্তমানে ১১-১২ লাখ টনে নেমে এসেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে পণ্যটির মোট উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০.৮৬ লাখ টনে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩)। এ উৎপাদন দেশের চাহিদার (কমবেশি ৭৫ লাখ টন) ৭ ভাগের ১ ভাগ। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ পণ্যটির দাম অনেকটা আকাশছোঁয়া। ফলে স্বাস্থ্যগত কারণসহ বিভিন্ন কারণে গমের আটা-ময়দার ওপর নির্ভরশীল অনেকে চালের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এতে চালের ওপর অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর (২০২২) বাংলাদেশে প্রকৃত মজুরি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি বছরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে (মে-তে ৯.৪ শতাংশ, যা ১১ বছর পর সর্বোচ্চ) প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুবই কম। এসব দিক বিবেচনা করে আগামী অর্থবছরে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ব্যবহার্য সার, জ্বালানি ও অন্যান্য উপকরণের ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধি না করার বিষয়ে সরকারকে দৃঢ় অবস্থানে থাকতে হবে। কৃষি খাত যে আমাদের প্রকৃত বন্ধু তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার প্রকোপকালে। অন্যান্য খাত যখন বিপর্যস্ত, তখন কৃষি খাত আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম