আদি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নবজাগরণ
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি
প্রকাশ: ২২ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গজারিয়া-মতলব সেতু নির্মাণ প্রকল্প। ফাইল ছবি
মেঘনা-ধনাগোদা নদীর ওপর গজারিয়া-মতলব সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম একে ইতিবাচক বলেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, গজারিয়ার ভবেরচর থেকে মতলব-উত্তরের কালীপুর পর্যন্ত নির্মিত হবে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের এ সেতু। মধুমতী সেতুর আদলে এটি নির্মিত হবে। ২০২২ সালে ৯৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল ৬৯০ মিটার দীর্ঘ মধুমতী সেতু। সেটি নির্মিত হয় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি ও নড়াইলের লোহাগড়ার মধ্যে। একই বছরে পরিকল্পিত হয় তার প্রায় তিনগুণ ২০০০ মিটার দীর্ঘ গজারিয়া-মতলব সেতু। আঞ্চলিক সড়কের ওপর নির্মিত সেতুটি ভবেরচরে গিয়ে মিলিত হবে ব্যস্ততম মহাসড়কের সঙ্গে। তখন এটি আর আঞ্চলিক সড়ক থাকবে না, হয়ে যাবে দ্বিতীয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যেভাবে চট্টগ্রাম পৌঁছেছে, পরিকল্পিত সড়কটি চট্টগ্রাম পৌঁছাবে ঠিক তার বিপরীত দিক দিয়ে। প্রথমটি গজারিয়া-দাউদকান্দি-চান্দিনা-চৌদ্দগ্রাম-ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। পরিকল্পিত সড়কটি গজারিয়া থেকে মতলব-চাঁদপুর হয়ে লক্ষ্মীপুর-ফেনী সড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। একটি উত্তল উপবৃত্তের মতো, অন্যটি অবতল উপবৃত্ত। প্রথমটি নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিককালে-চট্টগ্রাম-দাউদকান্দি অংশ ব্রিটিশ আমলে আর গজারিয়া অংশ পাকিস্তান আমলে। অন্যদিকে পরিকল্পিত সড়কটি চাঁদপুর পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছিল মধ্যযুগে। সংযোগ সেতু নির্মাণ করা হলে দ্বিতীয়টি হবে আদি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নবরূপায়ণ।
পরিকল্পিত সড়কটিকে কীভাবে বলা যায় আদি মহাসড়কের নবজাগরণ-তার একটি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। মধ্যযুগে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ছিল নদীপথে। স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ চট্টগ্রাম বিজয়ের পর চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রথম যে রাস্তা তৈরি করেন-তা ‘হদ্দিনের হথ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। চাঁদপুর থেকে সুলতানদের রাজধানী সোনারগাঁয়ের যোগাযোগ রক্ষিত হতো নদীপথে। সমগ্র মধ্যযুগজুড়ে এটিই ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন। আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকানের হামলা থেকে চট্টগ্রামকে রক্ষা করার জন্য রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের এটাই ছিল প্রধান সামরিক পথ। ১৮৬২ সালে গোয়ালন্দ ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর নির্মিত হওয়ার পর চাঁদপুরের ওপর নির্ভরতা বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণের পর ঢাকা-চাঁদপুর-ফেনী-চট্টগ্রামগামী পুরোনো মহাসড়কটি পরিত্যক্ত হয়। ষাট বছর পর যখন গজারিয়া-মতলবের ওপর দিয়ে মধ্যযুগের যোগাযোগব্যবস্থা নবায়ন করা হচ্ছে, তখন সংগত কারণে আগের নদীপথ বিয়োগ করে নির্মাণ করা হবে শুধুই সড়কপথ।
সড়কপথটি বাস্তবায়িত হতে পারত মুন্সীগঞ্জ সদর ও মতলব-উত্তরের ষাটনল লঞ্চঘাট বরাবর। কিন্তু এটি অতীতে যেমন ছিল অনুপযোগী, আজও তেমনি অনুপযোগী এ কারণে যে, পদ্মা-মেঘনার সংযোগস্থল হচ্ছে দেশের সবচেয়ে ভয়ংকর নদীপথ-সবচেয়ে বড় নৌ-দুর্ঘটনাগুলো যেখানে ঘটছে যুগ যুগ ধরে। শায়েস্তা খান তার শাসনামলে মহাসড়ককে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য নির্মাণ করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর-সংগ্রামগড় সড়ক (১৬৬৫-১৬৬৬); কিন্তু নদীভাঙনের কারণে বর্জিত হয় সে পথ। র্যালফ ফিচের বর্ণনা অনুযায়ী, সংগ্রামগড় হলো ঢাকা থেকে ৩০ মাইল দূরে কৌশলগত এক স্থান-শ্রীপুর ঘাঁটির বিপরীত পাড়ে ছিল যার অবস্থান। সোনারগাঁ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত অঞ্চলের মাটি ভঙ্গুরভূমির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় নদীর সমান্তরালে সড়ক নির্মাণ এখনো খুবই বিপজ্জনক। যে কারণে ষাটনল, মোহনগঞ্জ, এখলাসপুর হয়ে কখনো ‘রিভার ড্রাইভ’ হতে পারে না। সমুদ্র যত না বিপজ্জনক, তার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক পদ্মা-মেঘনার সম্মিলিত স্রোত-যে কারণে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা যতটা সহজ, ততটাই কঠিন হবে এ অঞ্চলে ‘রিভার ড্রাইভ’ নির্মাণ। আমরা নিশ্চয় স্মরণ রাখব পদ্মা-মেঘনার সর্বগ্রাসী ক্ষুধার কথা, সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায় যার ‘সহস্র ভুজ’ সর্বদা ব্যাপৃত ‘বিপর্যয় প্রলয়ের কাজে’। এসব কারণেই গজারিয়া-মতলব পথ বেছে নেওয়ার সময় পরিত্যাগ করা হয়েছে বাংলাদেশের ‘বারমুডা ট্র্যায়াঙ্গল’। তার পরিবর্তে গ্রহণ করা হয়েছে তুলনামূলকভাবে নিরীহ মেঘনা-ধনাগোদা নদীপথ। এতে ঢাকা থেকে চাঁদপুরের দূরত্ব কমে যাবে ৫২ কিলোমিটার। এখন দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার, ব্রিজটি নির্মাণের পর দূরত্ব হবে ৬৮ কিলোমিটার। একই সঙ্গে নির্মাণ করা দরকার হবে মুন্সীগঞ্জ-গজারিয়া সংযোগ সেতু, এটিও হতে পারে উড়ন্ত সেতু। তাতে পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব আরও কমে যাবে।
সংযোগ সেতু নির্মাণের ফলে অর্জিত হবে বহুমুখী সাফল্য। এটি হবে বাংলাদেশের নদীব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পরিবেশবান্ধব একটি সেতু। আশুগঞ্জ, ভৈরবের জলপথ থেকে চাঁদপুরের জলপথে যাতে কোনো নৌ-প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না হয়, তার দিকে লক্ষ রেখে এটিকে করা হবে ঝুলন্ত, পিলারবিহীন। সুলতানি আমল থেকেই যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল উত্তর-দক্ষিণমুখী রীতিতে। এখানে অনুসরণ করা হবে একই রীতি-যাতে বন্যার পানি সহজে নেমে যেতে পারে বঙ্গোপসাগরে। শুধু ইংরেজ আমলে পূর্ব-পশ্চিমমুখী নীতি অনুসরণ করায় স্রোতের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এবং দেখা দিতে শুরু করে অকাল বন্যা। এবার যখন পরিবেশবান্ধব রীতিতে নির্মাণ করা হবে সেতু, তখন স্বাভাবিকভাবেই মজে যাওয়া জলপথের সংস্কার করার দরকার হবে।
যতদূর জানা যায়, সেতুটি নির্মাণ করা হবে ভবেরচর থানাসংলগ্ন মধ্যবাউসিয়া মৌজার একটি নাল জমির ওপর দিয়ে। নালাটির নাব্যতা নিশ্চিত করা গেলে সেচ সুবিধাও বাড়বে। তিন ফসলি জমির ওপর দিয়ে নির্মিত সেতুটি যেন কৃষকবান্ধব হয়, সর্বাগ্রে খেয়াল রাখতে হবে সেদিকেও। মনে রাখতে হবে, এ এলাকা স্বচ্ছ পানি ও মাছের প্রজনন এবং উর্বরা জমি, জনসংখ্যা ও কৃষির জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। যে কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে জমির ওপর গেড়ে বসা বর্জ্যনিষ্কোষক ‘টাইম বোমা’গুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে সবার আগে।
ঝুলন্ত সেতু সাধারণত হয় নদীর ওপর, এটি হবে নালার ওপর। নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু পর্যটকবান্ধব হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে, এটি হবে কৃষির জন্য। রাষ্ট্রীয় অতিথিদের আমরা আগে নিয়ে যেতাম মেঘনার ‘রিভার ক্রুজে’-এ ব্রিজটি নির্মিত হলে মেঘনার সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে যুক্ত হবে কৃষির নতুন মাত্রা। মুন্সীগঞ্জ থেকে গজারিয়া এবং গজারিয়া থেকে ষাটনল এলাকা হতে পারে সম্প্রসারিত পর্যটন এলাকা। ব্রিস্টলে নির্মিত পৃথিবীর প্রথম ঝুলন্ত ‘ক্লিফটন ব্রিজ’ শুধু যোগাযোগের ক্ষেত্রেই নতুন যুগের সূচনা করে তাই নয়, একই সঙ্গে সৃষ্টি করে বিনোদনের এক প্রধান কেন্দ্র। তাই ব্রিজটি নির্মাণের সময় পর্যটকদের ভ্রমণ সুবিধার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থনৈতিক বিবেচনাতেও এটি হবে শ্রেষ্ঠ সংযোজন। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর ও পায়রা সমুদ্রবন্দর-এ তিনটি বন্দরের সঙ্গে চাঁদপুর নদীবন্দরের সংযোগসাধন হবে এক কথায় যুগান্তকারী অগ্রযাত্রা। এক নজরে দেখলে পরিকল্পিত পথরেখাটিকে দেখায় বহুভঙ্গিল বিদ্যুচ্চমকের মতো, বাণিজ্যিক দৃষ্টিতেও এটি হবে অভিনব। এতদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছিল একমুখী, এবার হবে দ্বিমুখী। একটি হতে পারে এক্সপ্রেসওয়ে, অন্যটি বন্দর যোগাযোগের জন্য বিশেষায়িত। তাছাড়া এতে হাজার বছরের পুরোনো একটি যোগাযোগ ব্যবস্থার নবজাগরণ সম্ভব হবে-যেভাবে চীন তার রেশমপথকে পুনরুজ্জীবিত করছে, ভারত পুনরুজ্জীবিত করছে তার কটন রুট।
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ, ঢাকা
mahmoodnasirjahangiri@gmail.com