Logo
Logo
×

বাতায়ন

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে

Icon

ড. মো. মফিজুর রহমান

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে

এসএমই খাত শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির চিত্র প্রত্যক্ষ করি, তা হলে এ খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করা যাবে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হচ্ছে জাপান। জাপানের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য মোতাবেক, জাপানের জাতীয় অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান ৯১ শতাংশ। মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান ৬০ শতাংশেরও বেশি। এমনকি ভারতের অর্থনীতিতেও এসএমই খাতের অবদান ৩৮ শতাংশ। থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান ৪৮ শতাংশ। জার্মানির অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান ৮৬ শতাংশের মতো। অর্থাৎ বিশ্বের যেসব দেশ যত বেশি উন্নত, তাদের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান তত বেশি। কথাটি অন্যভাবেও বলা যায়, যাদের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান যত বেশি, তারা তত উন্নত। এসএমই খাতের মাধ্যমে অর্জিত উন্নয়ন অধিকতর টেকসই ও স্থিতিশীল হয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এসএমই খাত একটি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসাবে কাজ করে।

বস্তুত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এসএমই খাতের কোনো বিকল্প নেই। এ খাত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। একটি দেশে ব্যাপকভিত্তিক উপযুক্ত ও পূর্ণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না গেলে কখনোই দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচন। আর দারিদ্র্য বিমোচনের সেই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে এসএমই খাতের বিকাশ ঘটানো। একটি দেশের অর্থনীতিকে সচল ও গতিশীল রাখতে হলে সবার জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। আর এসএমই খাত সেই কাজটিই অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করে থাকে। আমি এসএমই খাত বলতে কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্ট্রারপ্রাইজকে বোঝাচ্ছি। আগে আমাদের দেশে এসএমই খাতে কটেজ ও মাইক্রো শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হতো না। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বা অর্থায়ন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কটেজ অ্যান্ড মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিগুলো বঞ্চিত হতো।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কটেজ অ্যান্ড মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজকে অন্তর্ভুক্ত করে এ খাতের নতুন নামকরণ করেছে কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্ট্রারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগের ফলে কটেজ অ্যান্ড মাইক্রো শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বা অর্থায়ন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে। সিএমএসএমই খাতের শিল্পগুলোই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। সবার পক্ষে হঠাৎ করেই বৃহৎ শিল্প স্থাপন করা সম্ভব হয় না। এজন্য অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার পাশাপাশি বড় অঙ্কের মূলধন প্রয়োজন হয়। সবার পক্ষে এ তিনটি উপকরণ একযোগে জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেকেই সিএমএসএমই খাতের মাধ্যমে তাদের উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনের পর বৃহৎ শিল্প স্থাপন করেন। একজন উদ্যোক্তা হঠাৎ করেই সৃষ্টি হন না। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একজন সফল উদ্যোক্তা তৈরি হন। সিএমএসএমই খাত যদি বিকশিত হয়, তাহলে বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তারা তাদের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। বৃহৎ শিল্প এবং সিএমএসএমই খাতের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বরং এরা পরস্পর সহযোগী। এটা অর্থনীতির মূল সূত্র।

প্রশ্ন হলো, আমাদের অর্থনীতিতে সিএমএসএমই খাত কতটা অবদান রাখতে পারছে। নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের দেশের সিএমএসএমই খাত অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের অর্থনীতি যেভাবে দ্রুত উন্নতির দিকে যাচ্ছে, সিএমএসএমই খাত ঠিক ততটা অবদান রাখতে পারছে না। যদিও এ ক্ষেত্রে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে সিএমএসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ বলা হয়। কিন্তু এ হিসাবটি বেশ আগের। আমি মনে করি, আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে সিএমএসএমই খাতের অবদান ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। এ মুহূর্তে জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৭/৮ শতাংশ অবদান রাখছে বৃহৎ শিল্প আর অবশিষ্ট ২৯/৩০ শতাংশ অবদান রাখছে সিএমএসএমই খাত। দেশের সিএমএসএমই খাতে যারা যুক্ত আছেন, সেই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অত্যন্ত সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী। তারা সামান্য সহায়তা পেলেই যেকোনো অসাধ্য সাধন করে ফেলতে পারেন। তাই আমাদের সব পর্যায় থেকেই সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের সহায়তা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করতে হবে। বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রেও তাদের সহায়তা করতে হবে। দেশে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, তার প্রধান লক্ষ্য থাকতে হবে সিএমএসএমই খাতের উন্নয়ন।

একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করতে গেলে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অফিসে যেতে হয় সেবার জন্য। প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সহজেই সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের সহায়তা করে তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই তাদের হয়রানি করা যাবে না। বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন হওয়ার কারণে সেবাগ্রহীতাদের দুর্ভোগ অনেকটাই কমেছে। সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ। তাদের জন্য বাজার খুঁজে দিতে হবে। ভারত, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে এসএমই খাতের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় আছে। আমাদের দেশেও তেমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সিএমএসএমই খাতের জন্য একটি বিশেষায়িত ব্যাংক স্থাপন করা প্রয়োজন, যে ব্যাংক শুধু সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করবে। এ ব্যাংক সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি সংগ্রহ করে স্থাপন করা যেতে পারে। আমি মনে করি, এখন না হলেও কর্তৃপক্ষ হয়তো আগামীতে এ ধরনের একটি ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ নেবে। এসএমই ফাউন্ডেশনকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে ডিসপ্লে সেন্টার (প্রদশর্নী কেন্দ্র) স্থাপন করা জরুরি।

২০১৩ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন প্রথমবারের মতো ক্লাস্টার ম্যাপিং করেছে। আমাদের সংজ্ঞা অনুসারে, সন্নিহিত এলাকায় ৫ কিলোমিটারের মধ্যে যদি একই ধরনের অন্তত ৫০টি বা তারও বেশি উৎপাদন ইউনিট থাকে, তাহলে তাকে ক্লাস্টার বলা হয়। ২০১৩ সালে আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৭৭টি ক্লাস্টার চিহ্নিত করেছি। ৮০টি ক্লাস্টারের নিড অ্যাসেসমেন্ট করেছি। উল্লেখিত ক্লাস্টারের উদ্যোক্তাদের কী প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করা হয়েছে। ৩৭টি ক্লাস্টারে এখনো আমাদের সরাসরি ইন্টারভেনশন আছে। প্রথমে ক্লাস্টারের অন্তর্ভুক্ত উদ্যোক্তাদের নিড অ্যাসেসমেন্ট করে তাদের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা হয়। এসএমই ফাউন্ডেশন সরাসরি ব্যাংক ঋণ প্রদান করে না। আমরা এসএমই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে চুক্তিভুক্ত ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে থাকি। এসএমই ফাউন্ডেশনই ২০০৯ সালে সর্বপ্রথম সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণদানের ব্যবস্থা করে। করোনাকালীন সরকার থেকে দেওয়া অর্থ থেকে আমরা এখন ৪ শতাংশ সুদে সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণ দিচ্ছি। এটি রিভলভিং ফান্ড। আগে এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে ৯ শতাংশ সুদে যে ঋণ দেওয়া হতো তা এখন বন্ধ আছে। এখন ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন মিলে মোট ১৯টি ব্যাংকের সঙ্গে এসএমই ফাউন্ডেশনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ক্লাস্টার উদ্যোক্তাদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আমরা ব্যাংকগুলোকে বলেছি ক্লাস্টার উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ দানের জন্য। ক্লাস্টারভিত্তিক ঋণদান ব্যাংকের জন্য সহজ। তাদের কাছ থেকে ঋণের কিস্তি আদায় করাও অধিকতর সহজ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সিডিউল ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে, বিতরণকৃত ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের দিতে হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত। কারণ সাধারণভাবে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে থাকেন। এখন ব্যাংক যদি বাধ্যতামূলকভাবে তাদের বিতরণকৃত ঋণের ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের প্রদান করে, তাহলে এ খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা অনেকটাই দূর হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, করোনাকালে বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য যে ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, সেই প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে এসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তারা ঋণ পেয়েছেন ৬ শতাংশেরও কম। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এ খাতের উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন সংকট অনেকটাই দূর হবে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা বিশেষভাবে উপকৃত হবেন।

দেশে সিএমএসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতাও প্রশংসনীয়। আমি মনে করি, আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিলে নারী উদ্যোক্তাদের অধিক হারে ব্যাংকঋণ দেওয়া সম্ভব। আমরা এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি নারী উদ্যোক্তাকে ঋণ দিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা অত্যন্ত ভালো। তবে এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে ব্যাংকের মনোভাবের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংক এ উদ্যোগের বাইরেও একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কোনো ব্যাংকের ব্রাঞ্চ যদি নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দান করে এবং সেই ঋণের কিস্তি সঠিক সময়ে নিয়মিত আদায় হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট নারী উদ্যোক্তা ১ শতাংশ হারে রিবেট পাবেন। (অনুলিখন : এম এ খালেক)

ড. মো. মফিজুর রহমান : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই ফাউন্ডেশন)

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম