Logo
Logo
×

বাতায়ন

আশেপাশে চারপাশে

টেকসই বাঁধের প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল ‘মোখা’

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ২০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

টেকসই বাঁধের প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল ‘মোখা’

সব আতঙ্ক আর আশঙ্কাকে দূর করে দিয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা গত রোববার (১৪ মে) রাতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় মিয়ানমার। স্থলভাগে এসে ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে পড়ে, এজন্য যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের মাটিতে মোখার অবস্থানের মোট সময় ছির মাত্র ৬ ঘণ্টা। এর আগে আর কোনো ঘূর্ণিঝড় এত কম সময় অবস্থান করেনি। ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের উপকূলে আসার পর সাগরে জোয়ার না থাকায় জলোচ্ছ্বাসও হয়নি। এসব কারণেই ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। কোনো প্রাণহানির খবরও পাওয়া যায়নি।

মোখার উৎপত্তি হয় ৮ মে বঙ্গোপসাগরে। সেদিন সাগরে একটি লঘুচাপের সৃষ্টি হয়। পরে সেটি নিম্নচাপ ও গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ১১ মে সকালে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর এটিকে প্রথমে ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড়’ ও পরে ‘অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়’ হিসাবে উল্লেখ করে। সমুদ্রবন্দরগুলোতে বিপদসংকেত দেওয়া শুরু হয়। কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদসংকেত এবং চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় ১১টি জেলায় ৮ নম্বর মহাবিপদসংকেত জারি করা হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম উপকূলে ৮ থেকে ১২ ফুট এবং অন্যান্য জেলার উপকূলে ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলে সতর্কবার্তা দেয়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায় উপকূলীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা নেওয়া হয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হয়। ১৩ জেলায় প্রায় ৭ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এসব কেন্দ্রে প্রায় ৮ লাখ মানুষ আশ্রয় নেয়। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকায় তারা ঘরে ফিরে যায়।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা যায়, ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি না ঘটলেও সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ ও টেকনাফ অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবখানেই বহু গাছপালা ভেঙে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে ব্যাপক হারে চলছে লোডশেডিং।

মোখা বিদায় নেওয়ার পর এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়টির তুলনায় বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি খুবই সামান্য, বিশেষ করে যদি অতীতের ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়। অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, মোখার শক্তি ও প্রচণ্ডতা ছিল ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়টির চেয়ে বেশি। সে কারণেই আবহাওয়াবিদ, সরকার এবং সাধারণ মানুষ উদ্বেগ ও আতঙ্কে ছিলেন।

মোখা সামান্য ক্ষতি করেই চলে গেছে, এটি আমাদের সৌভাগ্য। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মোখার অবস্থান ছিল মাত্র ৬ ঘণ্টা, যা অতীতের অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের তুলনায় সর্বনিম্ন। ফলে ঘূর্ণিঝড়টি বেশি ক্ষতি করার সময় পায়নি। জলোচ্ছ্বাস থেকেও রেহাই পাওয়া গেছে, কারণ ঘূর্ণিঝড় আমাদের উপকূলে আসার আগেই স্বাভাবিক জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০-১২ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। সেটা হয়নি বলে রক্ষা। হলে ১৯৯১ সালের মতো অবস্থা হতো, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হতো ব্যাপক।

মোখা এবার দুর্বল হয়ে চলে গেছে। কিন্তু মোখার মতো আরেকটি ঘূর্ণিঝড় যে আসবে না, তা কি কেউ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারে? ঘূর্ণিঝড়ের চরিত্রই এমন যে, একটি গেলে প্রায় সময়েই আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আসে। সেটা সবলও হতে পারে, দুর্বলও হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় এ দেশের একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় প্রতিবছরই বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম নভেম্বর এবং এপ্রিল-মে মাস।

প্রতিবছর এ সময় ছোটখাটো বা কম শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয় উপকূলীয় এলাকায়। কখনো কখনো ঘূর্ণিঝড় তীব্র হয়, ভয়াবহ হয়। যেমন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় দশ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। লাখ লাখ গবাদিপশু মারা যায়, কৃষি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সেই ঘূর্ণিঝড়টি বাঙালির জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে। কারণ, তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তাদের কোনো ত্রাণ তৎপরতাও ছিল না। পাকিস্তান সরকারের এ অবহেলা ও ঔদাসীন্য বাংলার মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যার প্রতিফলন ঘটে সেই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করে।

আরেকটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এসেছিল ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। সেই ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের প্রায় সব জেলা কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিশেষ করে বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা যায়। গবাদিপশু, কৃষি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা সেই ঘূর্ণিঝড়ে বিপুল প্রাণহানির জন্য যেসব কারণ চিহ্নিত করেছিলেন, তার মধ্যে ছিল যথাসময়ে আসন্ন দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা না দেওয়া।

সতর্কবার্তা ও বিপদসংকেত যখন দেওয়া শুরু হলো, তখন দেরি হয়ে গেছে। বহু মানুষ ঘরবাড়ি ফেলে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চায়নি অথবা আসার সময় পায়নি। বিপুলসংখ্যক জেলেনৌকা ও ট্রলার তখন গভীর সমুদ্রে ছিল, তারাও উপকূলে ফিরে আসার সময় পায়নি। তদুপরি ত্রাণব্যবস্থাও ছিল অপ্রতুল। দুর্যোগ মোকাবিলার আগাম প্রস্তুতিও সুশৃঙ্খল ও পর্যাপ্ত ছিল না। এসব কারণেই ১৯৯১ সালের সেই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক।

পরবর্তীকালে প্রায় প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এসেছে, চলে গেছে উপকূলে কম-বেশি ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি-২০০৭ সালের সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলা। এ দুটি ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় বেশ কটি জেলার বিশাল এলাকা তছনছ করেছিল। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। মানুষের প্রাণহানিও হয়েছে। তবে তা ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের মতো নয়, অনেক কম। দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতিতে তেমন ঘাটতি না থাকলেও বহু মানুষ স্বেচ্ছায় আশ্রয়কেন্দ্রে আসেনি। গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত বহু জেলেনৌকা ও ট্রলার বেতারে সতর্কবার্তা পেলেও উপকূলে ফিরতে দেরি করেছে। এ কারণেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল।

সিডর-আইলার অভিজ্ঞতার পর সরকার আরও সতর্ক হয়েছে, জনগণের সচেতনতাও বেড়েছে। যেমন, ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হলেও প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। দ্বীপবাসীরা আশ্রয়কেন্দ্র অথবা নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেছে। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেটা পূরণ করা যাবে। কিন্তু দ্বীপবাসীরা প্রাণে তো বেঁচেছে।

মোখার সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস আসেনি, এটি আমাদের জন্য বিরাট সৌভাগ্য। কারণ জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর জন্য উপকূলে যে দীর্ঘ বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েক দশক আগে, তার অবস্থা জরাজীর্ণ। টেকনাফ অঞ্চলের বেড়িবাঁধে ৩২টি জায়গা ভেঙে গেছে বলে সংবাদপত্রের খবরে দেখেছি। জলোচ্ছ্বাস হলে ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণেই টেকনাফ ডুবে যেত। সাতক্ষীরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত উপকূলীয় বেড়িবাঁধের সর্বত্রই প্রায় একই অবস্থা। টেকসই বেড়িবাঁধের দাবিতে স্থানীয় জনগণ আন্দোলন করছেন, গণমাধ্যমেও লেখালেখি হচ্ছে, কিন্তু সরকারের টনক নড়ছে না। সরকার পরিকল্পনা করে ঠিকই, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয় না। টেকসই বেড়িবাঁধ কবে হবে?

ঘূর্ণিঝড় বাঙালির চিরসঙ্গী। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণে সাগর থেকে ঘূর্ণিঝড় প্রতিবছর আসবে, সঙ্গে থাকবে জলোচ্ছ্বাস। এটি মেনে নিতে হবে। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ যুগে সবকিছু মেনে নিয়ে অসহায়ের মতো বসে থাকলে চলবে না। প্রযুক্তির সাহায্যে যথাসময়ে সঠিক সতর্কবার্তা দিতে হবে। সেই সঙ্গে রাখতে হবে দুর্যোগ মোকাবিলার যথাযথ প্রস্তুতি। উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ অবশ্যই করতে হবে জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর জন্য। তাহলে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা পাবে, উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা থাকবে, জাতীয় অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসকে ভাগ্যের লিখন বলে হাহাকার করলে কোনো লাভ হবে না। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে যথাযথভাবে মোকাবিলা করেই আমাদের বাঁচতে হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিতে হবে ফলপ্রসূ উন্নয়নের দিকে।

চপল বাশার : সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম