Logo
Logo
×

বাতায়ন

সাঁইত্রিশ শতাংশ পরিবার যখন ঋণগ্রস্ত

Icon

আবু তাহের খান

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাঁইত্রিশ শতাংশ পরিবার যখন ঋণগ্রস্ত

আগের কালের সামন্ত শাসক ও রাজরাজড়াদের জীবনে ভোগই ছিল মুখ্য। আর সে ভোগের উপকরণ জোগাতে গিয়ে প্রাণান্তকর পরিশ্রমে আহরিত উপার্জনের সিংহভাগই বিসর্জন দিতে হতো তাদের প্রজাদের। আর এরূপ রাজা-বাদশাহ ও সামন্ত প্রভুদের মোসাহেবরাই ঋণ করে হলেও ঘি খাওয়ার অবিবেচনাপ্রসূত পরামর্শ দিয়ে দরিদ্র প্রজাদের আরও দরিদ্র ও ব্যাপক পরিসরে ঋণগ্রস্ত করে তুলতেন।

এ ধারাবাহিকতাতেই জমি বেচে বা বন্ধক দিয়ে কিংবা দাদনদার-মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে হলেও মেয়ের বিয়েতে ধুমধাম করা কিংবা অনুরূপ ভোগবাদী কাজে অর্থ ব্যয় করার রীতি এদেশে ক্রমেই জোরদার হতে থাকে, যে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তবে শুধু ঘি খাওয়ার জন্য নয়, জীবনধারণ তথা সংসারের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্যও দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে এখন ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৩৭ শতাংশ পরিবারকে এখন ঋণ করে জীবনধারণ করতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে শুরুতেই স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে মানুষ যে বিনিয়োগ করছে, এ ঋণ তা থেকে ভিন্ন। এ ঋণ কোনোভাবেই বিনিয়োগ-ঋণ নয়। এ হচ্ছে জীবিকা নির্বাহের জন্য অর্থাৎ নিছক বেঁচে থাকার জন্য ঋণ গ্রহণ। এ ঋণ নিয়ে সে ঘরের চাল মেরামত করছে, পানীয় জলের জন্য নলকূপ বসাচ্ছে, চিকিৎসা-ব্যয় নির্বাহ করছে এবং সংসারের এ ধরনের অন্যান্য ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি পুরোনো ঋণের বকেয়া কিস্তিও পরিশোধ করছে। এবং বলতে কী, ঋণগ্রস্ত এ পরিবারগুলো অনেকটাই ঋণের চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং সহসা এ চক্র থেকে তারা বেরোতে পারবে বলেও মনে হচ্ছে না। কিছু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করা যাক, যা বাংলাদেশের মানুষের ঋণগ্রহণ বৈশিষ্ট্যের ধরনটিকে অনেকটাই স্পষ্ট করে তুলতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।

বিবিএসেরই পরিসংখ্যান বলছে, ঋণজালে আবদ্ধ মানুষের বেশিরভাগেরই বসবাস গ্রামে, যে হার প্রায় ৩৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এখন গ্রামে যেহেতু তুলনামূলকভাবে বিনিয়োগ-সুবিধা ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ কম, সেহেতু ঋণগ্রস্ত উল্লিখিত গ্রামীণ পরিবারগুলোর পক্ষে সহসা ঋণমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বরং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া, শিক্ষাব্যয়ের ক্রমবর্ধমানতা, সংসারে নতুন সন্তান জন্মলাভ, সমাজে ভোগপ্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার অনিবার্য নেতিবাচক পারিপার্শ্বিক প্রভাব ইত্যাদি কারণে ঋণগ্রহণের পরিমাণ ও হার দুই-ই আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই সর্বাধিক।

এর সঙ্গে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাজনিত ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়টি তো রয়েছেই। অন্যদিকে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার মানুষের পানীয়জল সংগ্রহের ব্যয়ও বহুলাংশে বেড়ে যাচ্ছে। একই কারণে সেখানকার আবাদি জমি ক্রমেই অধিক হারে লবণাক্ত হয়ে পড়ায় তা ফসলের উৎপাদনের ওপরও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং তাতে করে জীবিকার জন্য গ্রামীণ মানুষের বাড়তি ঋণগ্রহণ অনেকটাই অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

আগে রাজনৈতিক দলের মস্তান ও সামাজিক টাউটদের চাঁদাবাজি ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। এ মস্তান ও টাউটরা এখন গ্রামেও সমান সরব। আর ভোটের সুবিধা হাসিলের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এ টাউট ও মস্তানরা যেহেতু ইতোমধ্যে কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, সেহেতু সামনের দিনগুলোতে তাদের প্রভাব আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা চলে। এ ধারায় টাউট-বাটপার-মস্তানদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার যেহেতু সমূহ আশঙ্কা রয়েছে,

সেহেতু নিকট ভবিষ্যতের দিনগুলোতে তাদের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ যে আরও বাড়বে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর সামনে যেহেতু নির্বাচন, সেহেতু টাউট-বাটপারদের রাজনৈতিক কদর বেড়ে যাওয়ার কারণে ওই সময়ে তারা যে তাদের চাহিদার পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেবে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।

বিবিএসের জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, করোনা-উত্তর সময়েই জনগণের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, যার কারণ সহজেই বোধগম্য। আর এ তথ্য এ ইঙ্গিতই প্রদান করছে যে, করোনাকালে ব্যাপক ছাঁটাই ও অন্য নানা মাত্রিক কর্মহীনতার কারণে সাধারণ মানুষের আয়-উপার্জন যে হারে কমে গেছে, বর্তমানে তার বিপরীত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারলে অর্থাৎ ব্যাপক হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে না পারলে এ ঋণের ওপর নির্ভরতা আরও বহুলাংশে বেড়ে যাবে।

কিন্তু নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে হার, তাতে উল্লিখিত বিপরীত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আর এর মানে হচ্ছে, করোনার দাপট কেটে গেলেও জীবিকার জন্য ঋণ গ্রহণের হার না কমে বরং বাড়তেই থাকবে এবং সে ঋণ দিয়ে ঘি খাওয়া তো দূরের কথা-সাধারণ মানের চাল-ডালের খরচ কতটা নির্বিঘ্নে মেটানো যাবে, সেটিও এক প্রশ্ন বৈকি!

জরিপের ফলাফল থেকে এ তথ্যও মিলছে যে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ঋণগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা গ্রামের তুলনায় শহরগুলোতে অধিক হারে বেড়েছে। কারণটি সম্ভবত করোনার প্রকোপ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অন্য নানা কারণে আয় হ্রাসের ফলে গ্রামের মানুষ তাদের ভোগ ও ব্যয়ের পরিমাণও বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শহুরে পরিবারগুলো সম্ভবত তাদের সে ভোগ ও ব্যয়ের সঙ্গে আপস করতে অর্থাৎ তা হ্রাস করতে সম্মত হয়নি। ফলে ঋণের প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক যে উৎসই সে পেয়েছে, সেখান থেকেই সে ঋণ গ্রহণ করেছে। আর শহরে যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুযোগ অনেক বেশি ও অনেকটাই সহজ, সেহেতু ওই বাড়তি সুবিধার কারণে শহুরে পরিবারে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ এতটা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।

বিবিএসের খানা জরিপের যে তথ্যটি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক তা হচ্ছে, ২০১৬ সালের তুলনায় খানাপ্রতি ঋণ গ্রহণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া। ২০১৬ সালে খানাপ্রতি ঋণ গ্রহণের পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৭ হাজার ৭৪৩ টাকা, সেখানে ২০২২ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৫০৬ টাকায়। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে খানাপ্রতি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার চিত্র প্রমাণ করে-করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি নানা কারণে জীবন-জীবিকা নিয়ে সাধারণ মানুষ বস্তুতই চাপের মধ্যে আছে। এ বাস্তবতায় পরস্পরকে দোষারোপ কিংবা পরস্পরের ওপর দায় চাপানো বা দায় এড়ানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রের উচিত হবে এমন অর্থনৈতিক কৌশল গ্রহণ করা, যাতে সাধারণ মানুষ তার সীমিত আয় দিয়েই নিজ পরিবারের ন্যূনতম ভরণ-পোষণটুকু করতে পারে।

সেই সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে, সমাজে আয়-বৈষম্য যেভাবে বেড়ে গেছে এবং আরও যেভাবে বেড়ে চলেছে, তা যেন কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা সম্ভব হয়। নইলে নিয়ন্ত্রণহীন এ আয়-বৈষম্য আখেরে অন্যান্য ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণকেও শিথিল করে তুলতে পারে, যা আমাদের কারও কাম্য নয়। আমরা চাই এমন একটি সমাজ, যেখানে ভোগের প্রাচুর্য এবং জীবনধারণের ক্ষেত্রে আয়ের ব্যাপক ঘাটতি-এসবের কোনোটিই থাকবে না। নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা থাকলে এটি খুবই সম্ভব বলে মনে করি।

সামনে বাজেট। আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি বিত্ত-তোষণের চলমান ধারায় সাময়িক বিরতি দিয়ে হলেও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার কষ্ট খানিকটা হলেও কমানোর চেষ্টা করবেন?

অভিজ্ঞতা বলে, তারা তা করবেন না। তবু দৈবদুর্বিপাকের মতো আকস্মিক কোনো কারণে তেমন কোনো অভিপ্রায় যদি তাদের মনে জাগে, তাহলে প্রথম প্রস্তাব হবে, আসন্ন বাজেটে কৃষক ও গ্রামীণ মানুষকে কিছু সময়ের জন্য হলেও যেন প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের দণ্ড সুদ মওকুফের একটি সুবিধা প্রদান করা হয়, যেমনটি বিত্তবানদের জন্য প্রায়ই করা হচ্ছে। আর তা করা হলে ৩৭ শতাংশ ঋণগ্রস্ত মানুষ সাময়িকভাবে হলেও কিছুটা উপশম পাবেন বলে আশা করা যায়।

আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বিসিক; ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত

atkhan56@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম