অনুকরণীয় দেশপ্রেমের অধিকারী যে অর্থনীতিবিদ
মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদদের শিক্ষাগুরু, বাংলাদেশকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসার মানুষ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম গত ৮ মে ওয়াশিংটন সময় রাত ১২টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
এর সঙ্গে পরিসমাপ্তি ঘটল বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়ের। ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম খাদ্যনীতিবিষয়ক সংস্থা ইন্টান্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) ইমেরিটাস ফেলো হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এ দেশের কয়েকটি প্রজন্মের কাছে অর্থনীতির অবিসংবাদিত শিক্ষাগুরু। তার প্রয়াণে অপূরণীয় ক্ষতির প্রতিক্রিয়ায় দেশের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের এ যাবৎকালের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার মতো প্রভাবশালী আর কেউ ছিলেন না। সেটি উন্নয়ন গবেষণার ক্ষেত্রেই হোক, আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা হিসাবেই হোক বা বাংলাদেশের স্বার্থে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রেই হোক। তিনি চাইলে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় দায়িত্বে জীবনভর নিয়োজিত থাকতে পারতেন। কিন্তু তার নাড়ি পোতা ছিল বাংলাদেশে। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম দেশের স্বার্থেই কাজ করার প্রয়াসী ছিলেন। তৎকালীন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরূপণে তিনি ছিলেন সদা জাগ্রত। ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি প্রণয়নে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তার স্বদেশপ্রেমের কারণেই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক পরামর্শক হিসাবে কাজ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন অতি বলিষ্ঠভাবে।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ১৯২৯ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের পটিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুর রহমান ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। শৈশব ও কৈশোর জীবন তার চট্টগ্রামেই কাটে। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএ পাশ করার পর চলে যান কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানে পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার কর্মজীবন ছিল বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময়। প্রথমে ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। কিন্তু ৫ বছরের মাথায় সেই পেশা ছেড়ে যোগদান করেন পাকিস্তান ইনস্টিটিুউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিআইডিএস)। তিনি এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সহযোগী হিসাবে কাজ করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নফিল্ড ফাউন্ডেশনে। রকফেলার কর্মী হিসাবে কাজ করেছেন নেদারল্যান্ডস স্কুল অব ইকোনমিক্সে। তাছাড়া তিনি অক্সফোর্ডের সেন্ট এন্টনি কলেজের সহযোগী ছিলেন। সহকারী মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাগে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশন তার নেতৃত্বেই যাত্রা শুরু করে।
অধ্যাপক নুরুল ইসলামের প্রকাশিত গবেষণা গ্রন্থের সংখ্যা ২৯। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-‘ডেভেলপমেন্ট স্ট্রাটেজি অব বাংলাদেশ’ (১৯৭৮); ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ : এ স্টাডি ইন পলিটিক্যাল ইকোনমি’ (১৯৭৯); ‘ফুড গ্রেইন প্রাইস স্ট্যাবিলাইজেশন ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ইস্যুজ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্সেস ইন এশিয়া’ (১৯৯৬); ‘এক্সপ্লোরেশন ইন ডেভেলপমেন্ট ইস্যুজ : সিলেক্টেড আর্টিক্যালস অব নুরুল ইসলাম’ (২০০৩); ‘মেকিং অফ এ নেশন বাংলাদেশ : অ্যান ইকোনমিস্টস টেল’ (২০০৩); ‘অ্যান ওডিসি : জার্নি অফ মাই লাইফ’ (২০১৭) ইত্যাদি। তাত্ত্বিক ও উন্নয়ন অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য তিনি ২০০৯ সালে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার’ অর্জন করেন। এর বাইরে ২০১৩ সালে অর্জন করেন বিডিআই লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট।
অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মতো প্রতিভাময়ী মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা মূল্যায়নের কোনো যোগ্যতা ও ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও বাংলাদেশের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা উপলব্ধি করার যোগ্যতা ন্যূনতম মাত্রায় হলেও আমার আছে। তিনি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করতেন, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে পৃথক করে ভাবার কোনো সুযোগ নেই। একটি দেশের রাজনীতিই তার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে; অর্থনীতি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে না। সুতরাং সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তুলতে প্রয়োজন প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতি। তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, যে ‘দ্বিজাতি’তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সৃষ্টি হয়েছিল, এক দশকেরও কম সময়ে তা ‘দ্বি-অর্থনীতিতে’ পরিণত হয়েছে। আর এর পেছনে কারণ হলো পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানের রাজনীতি। তাই তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির প্রয়োজনে রাজনৈতিক মুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রণয়নে ব্রতী হন।
মূলত পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর নির্ভর করেই পশ্চিম পাকিস্তান তার অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করেছিল। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তার গবেষণায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পঞ্চাশের থেকে ষাটের দশকে কী পরিমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য বিরাজ করছিল, তার একটি সহজ চিত্রায়ণ করেছেন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষের মাথাপিছু গড় উন্নয়নের জন্য ১৯৫১-৫২ এবং ১৯৫৯-৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের বরাদ্দ পূর্ব পাকিস্তানের থেকে প্রায় পাঁচগুণ বেশি ছিল। চল্লিশের দশকের শেষের দিকে (১৯৪৯-৫০) পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু গড় আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি ছিল, যা পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ৩২ শতাংশে উন্নীত হয়। অর্থাৎ এক দশকে পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ আয়-বৈষম্য দেখা দেয়। এ ছাড়াও, ষাটের দশকের গোড়ার দিকে পাকিস্তানের মোট বিনিয়োগের মাত্র ১৩ শতাংশ হয় পূর্ব পাকিস্তানে, যা একটি রাষ্ট্রের দুর্বল অর্থনৈতিক অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করে। (শুভাশীষ পাল, ২০২৩)।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংকীর্ণ সংস্কৃতির উপস্থিতির কারণে আমরা অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সব সক্ষমতাকে ধারণ করতে ও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার মতো নগণ্য মানুষের মুখে অমন ব্যর্থতার কথা বলার পেছনে কারণ হলো অধ্যাপক নুরুল ইসলামের লেখা অতিপরিচিত বই ‘বাংলাদেশ : জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা’। এ বইতে তিনি যে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, তা থেকে সে সময়কার রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক অবস্থা কিছুটা আঁচ করা যায়। ১৯৭৫ সালের আগস্টের আগেই তিনি বাংলাদেশের কাজ ছেড়ে অক্সফোর্ডের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা তিনি অক্সফোর্ডে বসেই শুনতে পান এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের ছবি সেখানকার টেলিভিশনে দেখতে পান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সর্বশেষ সাক্ষাতের সময়টা ছিল ১৯৭৫ সালের মে মাসের শেষের দিকে। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তার আগের দায়িত্ব থেকে তত দিনে অব্যাহতি নিয়ে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের কথা থেকেই অনুমান করা যায়, অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কিছুটা অভিমান ছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ‘আমাকে আর পূর্বের অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে না। আমার কাজকর্মে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাবো এবং কোনো বাধা ছাড়াই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে সর্বপ্রকার কাজ করতে পারব। শুধু দেশের স্বার্থরক্ষা ছাড়া আর কোনো শর্ত থাকবে না বলে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিয়ম অনুসরণ করা হবে কঠোরভাবে, কোনোরকম বিচ্যুতি সহ্য করা হবে না।’ (পৃষ্ঠা : ৮৬)।
বঙ্গবন্ধুর এ আশ্বাসের পরও তিনি তা গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বঙ্গবন্ধু যখন তৎকালীন যুগোস্লাভিয়া সফরে যান, সে সময়ে সে দেশের প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর কাছেও আমলাতন্ত্র বিষয়ে তার অসহায় পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। কিন্তু কার্যকর কোনো ফলাফল তখনো দৃশ্যমান হয়নি, যে কারণে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের আস্থার যৌক্তিক অভাব ছিল। কারণ, ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে একটি দক্ষতাসম্পন্ন আমলাতন্ত্র গড়ে তোলার অসম্পূর্ণ যে কাজ, তা এখনো আমাদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।’ (পৃষ্ঠা: ৯৬)।
এ কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়