Logo
Logo
×

বাতায়ন

মানবিকতার কান্ডারি রেড ক্রস-রেড ক্রিসেন্ট

Icon

এম এ হালিম

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানবিকতার কান্ডারি রেড ক্রস-রেড ক্রিসেন্ট

বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দুর্যোগ ও মানবিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। ২০২২ সালে সারা বিশ্বে ৪২১টি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবিক সংকট (যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, জাতিগত হানাহানি ইত্যাদি) সংঘটিত হয়েছে। এসবের মধ্যে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা আর ইউক্রেন যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে ভূমিকম্পের আঘাত এবং ১৫ এপ্রিল সুদানে শুরু হওয়া অভ্যন্তরীণ সংঘাত থেকে সৃষ্টি হয়েছে মানবিক বিপর্যয়। বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক নেটওয়ার্ক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের ১৯২টি দেশে ছড়িয়ে থাকা ১৪.৫ মিলিয়ন স্বেচ্ছাসেবক এসব দুর্যোগ ও সংকটে মানবিক সেবা প্রদান করছেন প্রতিনিয়ত। ২০২২ সালে সংঘটিত ৪২১টি দুর্যোগ ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংঘটিত সব দুর্যোগে রেড ক্রস তার ১৯২টি জাতীয় সোসাইটির মাধ্যমে ১.১ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সেবা পৌঁছে দিয়েছে। একমাত্র ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ৮০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু এবং ৬০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত (আইডিপি) হয়েছে। এ মানবিক সংকটেও ৫৮টি জাতীয় সোসাইটির ১২ হাজার ৫০০ কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক ১ কোটি ৪০ লাখ উদ্বাস্তু ও আইডিপিকে কোনো না কোনো সেবা অব্যাহতভাবে পৌঁছে দিচ্ছেন, যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য ও জরুরি ত্রাণ, আশ্রয়ণ (তাঁবু, ঘর), স্বাস্থ্য ও মনো-সামাজিক সেবা, পানি ও পয়ঃসুবিধা ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) তার ম্যানডেট ও জেনেভা কনভেনশনের প্রচারক হিসাবে যুদ্ধবন্দিদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করতে এসব বন্দিকে নিয়মিত পরিদর্শন করে থাকে। এছাড়া যুদ্ধের ফলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের মধ্যে যোগাযোগ পুনঃস্থাপনেও আইসিআরসি কাজ করছে। এ দেশেও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিডিআরসিএস) মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীকালে যুদ্ধাহতদের সেবা এবং পরবর্তী সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংকটে মানবিক সেবা পরিচালনা করেছে ও করছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে অবস্থানকারী ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে বিডিআরসিএস বিভিন্ন মানবিক সহায়তা পরিচালনা করছে।

আজ ৮ মে বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস। এ সংস্থার প্রতিষ্ঠা ১৮৬৩ সালে। ১৯৪৮ সাল থেকে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের উদ্যোক্তা হেনরি ডুনান্টের জন্মদিন অর্থাৎ ৮ মে বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস হিসাবে উদ্যাপন করা হচ্ছে। কারণ, বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মানবিক প্রতিষ্ঠানের সূচনার সঙ্গে হেনরি ডুনান্টের অবদান মিশে আছে অবিচ্ছেদ্যভাবে।

Welfare Society of Geneva ১৮৬৩ সালে ডুনান্টের প্রস্তাব অনুযায়ী জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। ডুনান্ট কতিপয় সুপারিশসংবলিত একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন, যার মূল বার্তা হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক স্থায়ী সেবা সংস্থা গঠিত হবে এবং প্রতিটি দেশে থাকবে এর একটি জাতীয় শাখা। প্রতিটি দেশের সরকার যুদ্ধস্থলে ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের অনুমতি প্রদান করবে। আর্মি মেডিক্যাল সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকদের যুদ্ধস্থলে নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসাবে প্রবেশাধিকার দেবে। আর্মি মেডিকেল সদস্যরা ইউনিফর্ম না পরে একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রতীক ব্যবহার করবে এবং তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না। ২৩ থেকে ২৬ অক্টোবর (১৯৬৩) অনুষ্ঠিত সেই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, একটি সাদা কাপড়ের ওপর লাল যোগচিহ্নসংবলিত প্রতীক ব্যবহার করবে সংগঠন ও তার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা। অনুমান করা হয়, এ ধরনের সংগঠন গঠন ও প্রতীকের উদ্ভাবক হেনরি ডুনান্ট এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনে সহযোগিতার জন্য তার দেশ সুইজারল্যান্ডের প্রতি সম্মান জানাতেই সে দেশের জাতীয় পতাকার অনুরূপ চিহ্ন হিসাবে রেড ক্রস চিহ্নটি গৃহীত হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় International Committee of the Red Cross বা আইসিআরসি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশ নিজ নিজ দেশের এ সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রেড ক্রিসেন্ট নাম গ্রহণ করে। বাংলাদেশেও রেড ক্রস ১৯৮৮ সালে নাম পরিবর্তন করে রেড ক্রিসেন্ট নাম গ্রহণ করে। তবে উদ্দেশ্য ও আদর্শের দিক থেকে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্টের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, একই সংস্থার দুটি প্রতীক মাত্র।

যুদ্ধকালে যুদ্ধাহত সৈন্য এবং তাদের সেবাদানকারী রেড ক্রস প্রতীকধারীদের নিরাপত্তার বিষয়কে সামনে রেখে ১৮৬৪ সালে জেনেভা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো চুক্তিবদ্ধ হয় যে, যুদ্ধকালে যুদ্ধাহত ও অসুস্থ সৈন্য এবং তাদের শুশ্রূষাকারী রেড ক্রস প্রতীকধারী ব্যক্তি, অ্যাম্বুলেন্স ও হাসপাতালকে নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করবে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। এ চুক্তিই ঐতিহাসিক ‘জেনেভা কনভেনশন’ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে সময়ের প্রয়োজনে ১৯০৬ সালে নৌ-যুদ্ধে আহত সৈন্যদের নিরাপত্তা, ১৯২৯ সালে যুদ্ধবন্দিদের প্রতি মানবিক আচরণ এবং ১৯৪৯ সালে যুদ্ধকালে বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তার বিধানসংবলিত যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। এদিকে বিভিন্ন দেশে রেড ক্রস ও এর কার্যক্ষেত্র সম্প্রসারণ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৯ সালে বিভিন্ন দেশের জাতীয় রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সমন্বয়ের সুবিধার্থে International Federation of Red Cross and Red Crescent Societies (IFRC) গঠিত হয়। ফলে আইসিআরসি যুদ্ধাহতদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিতকরণ, যুদ্ধবন্দি বিনিময়, রেড ক্রস-রেড ক্রিসেন্ট প্রতীকের সুরক্ষা, জেনেভা কনভেনশনের বিশ্বস্ত পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি ভূমিকা পালন করে থাকে। অপর দিকে আইএফআরসি জাতীয় সোসাইটিগুলোর একটি ফেডারেশন হিসাবে সোসাইটিগুলোর উন্নয়নে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সংশ্লিষ্ট জাতীয় সোসাইটির মাধ্যমে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে। যুদ্ধকালে মানবিক সেবার লক্ষ্যে রেড ক্রস প্রতিষ্ঠিত হলেও কালের পরিবর্তনে এ সংস্থার সেবার ক্ষেত্র অনেক প্রসারিত হয়েছে।

এ বছর দিনটির প্রতিপাদ্য হলো ‘Everything we do, comes from the heart-‘রেড ক্রস যা কিছুই মানুষের জন্য করে, তা প্রকৃত অর্থেই আন্তরিকতার সঙ্গে করে’। রেড ক্রস সবসময়ই কিছু আদর্শ অনুসরণ করে, যার তাৎপর্য হলো সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া দুর্গত/বিপদাপন্ন মানুষের অধিকার রক্ষায় সহায়তা করা, দয়া করা নয়। তাই মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রেড ক্রস বা রেড ক্রিসেন্ট অসহায় মানুষের প্রতি দয়া করে না, বরং তাদের দুর্দশায় সহানুভূতি জানাতেই সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়ায়, যা তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করে। রেড ক্রস সবসময় ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে, যা সব উদ্যোগ টেকসই হতে ভূমিকা রাখে। এ প্রতিষ্ঠানটি এসব আদর্শ, বিশ্বাস, উদ্যোগ ও নিঃস্বার্থ মানবিক সেবার জন্য তিনবার (১৯১৭, ১৯৪৪ ও ১৯৬৩) নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। এছাড়া রেড ক্রস প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিগত অবদান ও ভূমিকার জন্য হেনরি ডুনান্ট ১৯০১ সালে প্রথম শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর মানবিক সেবার জন্য আইসিআরসিকে ২০১২ সালে Friends of Liberation War Honor প্রদান করে।

১৬০ বছর আগে ইউরোপে সূচনা হলেও আজ ১৯২টি দেশে রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্ট বিশ্বের যে কোনো দুর্যোগ বা সংকটে মানবতার কান্ডারির ভূমিকায় আসীন। বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবসে তাই এ মানবিক সংগঠনের প্রবর্তক হেনরি ডুনান্টকে কৃতজ্ঞভরে স্মরণ করি।

এমএ হালিম : বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচালক, দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ

halim_64@hotmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম