Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সদ্ব্যবহার করতে হবে

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সদ্ব্যবহার করতে হবে

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

৯ এপ্রিল প্রকাশিত এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে চূড়ান্ত জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জনে।

এর আগে গত বছরের জুনে প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৫১ লাখে। এবারের জনশুমারির দুটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য। একটি হলো, শ্রমশক্তির চূড়ামণি তরুণ শ্রমশক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি। তরুণ শ্রমশক্তি দাঁড়িয়েছে মোট জনগোষ্ঠীর ৩২.৮৪ শতাংশে।

অন্যটি হলো কর্মক্ষম জনশক্তির সংখ্যাধিক্য। ১৫-৬৪ বছর বয়সি কর্মক্ষম শ্রমশক্তির সংখ্যা হলো -১১ কোটি ৭ লাখ, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৫.২৩ শতাংশ। এর অর্থ হলো, দেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যা তাত্ত্বীক বোনাসকালের সুবিধা ভোগ করছে।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হলো কোনো দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি জনসংখ্যার আধিক্য।

যখন এ কর্মক্ষম জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি থাকে, তখন ওই দেশ ডেমোগ্রাফিক বোনাসকালে অবস্থান করছে বলে ধরা হয়। বাংলাদেশ কীভাবে এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সদ্ব্যবহার করতে পারে, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারির প্রবল প্রকোপে অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং কর্মসংস্থানে মূল ভ‚মিকা পালনকারী বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি, বেতন/মজুরি হ্রাস এবং অন্যান্য কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষের আয় হ্রাস পায়। সম্প্রতি বিবিএস প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২১’ অনুযায়ী দেশে যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২০১৭ সালের ১.৩৭ শতাংশেই রয়েছে, তখন ২৯ মার্চ বিবিএস প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক রিপোর্টে দেশে বেকারত্বের হার হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এখন বেকারত্বের হার ৩.৬ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ছিল ৪.২ শতাংশ। উলে­খ্য, বেকার সংখ্যার হিসাবটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী করে বিবিএস। আইএলওর সংজ্ঞা বলছে, ৩০ দিন ধরে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি সর্বশেষ ৭ দিনে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাকে বেকার হিসাবে ধরা হবে। আইএলও’র সংজ্ঞায় নির্ধারিত বেকারত্ব হারের সঙ্গে একমত নন দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ। তারা বলছেন, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ পেলে ওই ব্যক্তিকে বেকার ধরা হবে না -এ সংজ্ঞা আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই অর্থবহ নয়। এগুলো শিল্পোন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য। তাই বাংলাদেশে আন্ডার এমপ্লয়েড বা ছদ্মবেকার কত আছে, তা জানতে হবে।

আইএলও-এর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের কর্মসংস্থান নিয়ে ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ২০১০ সালের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে ৪ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা বিবিএস-এর ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপের হারের (৪ দশমিক ২ শতাংশ) চেয়ে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বেশি। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর মধ্যে সরকারি খাতে কর্মসংস্থান সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। দেশটিতে মোট কর্মসংস্থানে সরকারি খাতের অবদান মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ। ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ পরিচালিত ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ওয়ার্কপ্লেস ২০২১’ অনুযায়ী, করোনার সময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষের আয় হ্রাস পায়। দেশের কয়েকটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান/সংস্থা যেমন : সিপিডি, পিপিআরসি, বিআইজিডির মতে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ বেকারত্ব বৃদ্ধি। বলা হয়, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই বিবিএস প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক রিপোর্টে উলি­খিত ৩.৬ শতাংশ বেকারত্বের হার নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

দেশে শ্রমশক্তির উল­ম্ফন ঘটছে; কিন্তু সেই শ্রমশক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে -এক. শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য। বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত যুবক প্রতিবছর শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। দুই. শ্রমবাজারের চাহিদা ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ফারাক। শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার বহুলাংশে মিল না থাকায় বাড়ছে শিক্ষিত যুব বেকারের সংখ্যা। তিন. দেশের বেশির ভাগ শিক্ষিত যুবক নিজস্ব ব্যবসা বা আত্মকর্মসংস্থানে আÍবিশ্বাসী নয়। তারা কোনোরকম একটি চাকরি নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনে আগ্রহী। অবশ্য দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা তাদের আÍকর্মসংস্থানে উদ্যোগী হতে সাহস জোগায় না। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য হলো -তহবিলের অভাব, প্রশাসনিক জটিলতা এবং ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ নীতিমালা উদ্যোক্তাবান্ধব না হওয়া। চার. প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসছে। এটি অর্থনীতির প্রায় সব খাতে এবং শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সরকারের উদ্যোগে পরিচালিত একটি স্টাডির বরাত দিয়ে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে দেশের পাঁচটি স্পেশালাইজড ইন্ডাস্ট্রি -গার্মেন্ট, খাদ্য ও কৃষি, ফার্নিচার, ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি এবং লেদার ও ফুটওয়্যারে ৫৩ লাখ ৮০ হাজার কর্মসংস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে আগামী দুই দশকে এসব কর্মসংস্থান উধাও হয়ে যাবে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান কমবে গার্মেন্ট খাতে।

এ অবস্থায় এই মুহূর্তে যা দরকার তা হলো ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সদ্ব্যবহারে পুরোপুরি মনোযোগী হওয়া। অর্থনীতিবিদদের মতে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড থেকে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য হলো -ক. শ্রমের জোগানের উন্নতি, খ. সঞ্চয়ের প্রবৃদ্ধি, গ. মানবপুঁজি এবং ঘ. দেশীয় বাজার সম্প্রসারণ। এসব সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে যদি কর্মক্ষম জনশক্তিকে, বিশেষ করে কর্মক্ষম তরুণ শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানো যায়।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে আমাদের যেসব বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে -ক. প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি। বৈদেশিক অভিবাসন থেকে কর্মসৃজন ও আয় উপার্জন ত্বরান্বিত করতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেশকিছু সুপারিশ রাখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উলে­খ্যযোগ্য হলো -১. বিশ্বের শ্রমঘাটতি দেশগুলোর সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শ্রমশক্তি পাঠানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ২. দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দরিদ্রতম জেলাগুলোয় বৈদেশিক অভিবাসনে সহায়তা করা; ৩. অভিবাসনের খরচ কমাতে উপায় বের করা; ৪. হাইকমিশনের মাধ্যমে তথ্য ও দুর্নীতিবিরোধী সেবাগুলো দেওয়া; ৫. প্রবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্স পাঠাতে ভালো ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়া। খ. শিক্ষিত যুবকদের

আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নিতে হবে। তরুণদের মধ্যে সব ধরনের ব্যবসার উদ্যোগ সৃষ্টি করতে বাজেটে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা নিতে হবে। গ. পুষ্টিহীনতা কর্মক্ষম শ্রমশক্তির উন্নয়নে একটি বড় অন্তরায়। জনগণকে কর্মক্ষম শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করার জন্য তাদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। ঘ. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বা অটোমেশনের কারণে কয়েকটি স্পেশালাইজড ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মসংস্থান হ্রাসের যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিতে হবে। ঙ. বর্তমানে ৬৫.২৩ শতাংশ কর্মঠ মানুষের একটি অংশ, বিশেষ করে চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্তরা উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত নেই। তারা কর্মদক্ষ হলেও কাজ পাচ্ছেন না। তাই তারা অর্থনীতিতে দৃশ্যমান কোনো ভ‚মিকা রাখছেন না। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের উৎপাদনমুখী করতে হবে। এটা করা গেলে বাড়বে জিডিপির পরিমাণ।

ডেমোগ্রাফারদের মতে, কোনো দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পিরিয়ড ২০-৩০ বছরের বেশি হয় না। জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর হিসাবে দেশে ষাটোর্ধ্ব জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পেয়ে মোট জনসংখ্যার ৯.২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং আগামী দিনে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। আর ক্রমেই হ্রাস পাবে তরুণ জনসংখ্যা। অর্থাৎ হ্রাস পাবে কর্মক্ষম জনসংখ্যা। তাই বর্তমানের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা না করা গেলে এ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম