Logo
Logo
×

বাতায়ন

আপনার কণ্ঠস্বরের যত্ন নিন

Icon

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আপনার কণ্ঠস্বরের যত্ন নিন

মনের ভাব প্রকাশের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে কণ্ঠ, আর মানুষে মানুষে যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম আমাদের মুখের ভাষা।

এই গলার স্বর/কণ্ঠ অবশ্যই মহান সৃষ্টিকর্তার অনন্য এক উপহার যা এক শিল্প। আমাদের গলার সামনের দিকে স্বরযন্ত্র (Larynx) অবস্থিত, যা দেখা যায় না মোটেও; কিন্তু এর অস্তিত্ব ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। শব্দযন্ত্রে দুটি কণ্ঠনালি (Vocal cord) থাকে। এ নালি দুটির কম্পনের মাধ্যমে শব্দ তৈরি হয়।

আজ বিশ্ব কণ্ঠ দিবস। আমরা কণ্ঠস্বর সম্পর্কে ততটা সচেতন নই। তাই এ দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কণ্ঠ ও কণ্ঠনালির সমস্যা এবং সেই সঙ্গে কীভাবে কণ্ঠকে সুস্থ রাখা যায় তা জনগণকে জানানো। সারা বিশ্বে ২০০২ সাল থেকে বিশ্ব কণ্ঠ দিবস পালিত হচ্ছে। তবে দেশে এ দিবস পালিত হচ্ছে ২০০৮ সাল থেকে। এবারের বিশ্ব কণ্ঠ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো-‘Your Voice Matters’, যার বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায়-‘আপনার কণ্ঠস্বরের প্রতি সদয় হোন’। আমেরিকান একাডেমি অফ অটোলারিঙ্গোলজি-হেড অ্যান্ড নেক সার্জারির (AAO-HNS) প্রস্তাবিত এ প্রতিপাদ্যটি আমাদের কণ্ঠস্বরের যথাযথ ও গুণগত যত্ন নেওয়ার কথা বলে, যাতে আমরা নিজেদের সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারি এবং আমাদের যোগাযোগ দক্ষতা উন্নত হয়।

একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব কেমন তার অনেকটাই নির্ভর করে তার কণ্ঠের ওপর। তাই নিজের সুস্থ থাকার পাশাপাশি শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো প্রতিদিন কণ্ঠস্বরেরও যত্ন প্রয়োজন। আর এ জন্য দরকার কণ্ঠের পরিমিত ও নিয়ন্ত্রিত সদ্ব্যবহার।

কণ্ঠস্বরের যত্নে করণীয়

১. অযথা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি থেকে বিরত থাকতে হবে। উচ্চৈঃস্বরে কথা বললে ভোকাল কর্ডে মাইক্রোহেমোরেজ নামক সমস্যা হয়। এতে রক্ত জমাট হয়ে বা নালি শক্ত বা ফ্রাইব্রোসিস হয়ে অনেক সময় কণ্ঠ পরিবর্তন হয়ে যায়। অনেক সময় শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে জোরে কথা বলে মনের অজান্তে ক্ষতি করে থাকেন। রাজনৈতিক নেতারা জনসভায়, মায়েরা বাচ্চাদের সঙ্গে, ফেরিওয়ালা, হকারসহ কণ্ঠনিভর্র বিভিন্ন পেশাজীবী উচ্চস্বরে কথা বলেন। কণ্ঠের যত্নে জনবহুল জায়গায় শোরগোলের স্থানে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা উচিত নয়।

২. ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। ধূমপান সরাসরি আক্রমণ করে গলার যে কোনো সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয় এবং জটিল করে তোলে। এতে কণ্ঠনালির ক্ষতি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০-৮৫ শতাংশ কণ্ঠনালির ক্যানসারের রোগী ধূমপায়ী।

৩. অত্যধিক ঠান্ডা পানি পরিহার করুন। অনেক সময় প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বাইরে থেকে এসেই হুট করে আমরা ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করি, যা আমাদের গলার জন্য ক্ষতিকর। যাদের ঠান্ডা অ্যালার্জিজনিত সমস্যা আছে, তাদের বিশেষ সতর্কতা মেনে চলা উচিত। এছাড়া ঘাম অনেকক্ষণ ধরে শরীরে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে, এর ফলেও গলা ভেঙে যায়। ঠান্ডা লেগে যদি গলা বসে যায়, তবে কথা বলা বন্ধ করতে হবে বা কমিয়ে দিতে হবে। কণ্ঠনালিকে বিশ্রাম দিতে হবে, এমনকি ফিসফিস করেও কথা বলা যাবে না। গলা ভাঙা উপশমে এক্ষেত্রে ভালো পদ্ধতি হলো গরম বাষ্প টানা। ফুটন্ত পানির বাষ্প যদি দৈনিক অন্তত ১০ মিনিট মুখ ও গলা দিয়ে টানা হয়, তাহলে উপকার হবে। মেনথল ইনহেলেশনও ভোকাল কর্ডকে কিছুটা আর্দ্রতা দিয়ে থাকে।

৪. পানি পানে অনীহা নয়। পানিশূন্যতা গলা ভাঙার আরেকটি রিস্ক ফ্যাক্টর। অনেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করেন না। সারাদিন কথা বলছেন, অথচ পানি পান করছেন না-এসব কারণে কণ্ঠের ক্ষতি হয়। আর্দ্রতা কণ্ঠের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি, তাই কণ্ঠের সুস্থতার জন্য প্রতিদিন অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে। কফি, কোমল পানীয় শরীরের কোষে পানিশূন্যতা ঘটায়; তাই অতিরিক্ত কফি বা কোমল পানীয় পরিহার করতে হবে।

৫. খাদ্যাভ্যাসে এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে দিতে হবে বিশেষ নজর। আমাদের একটি অভ্যাস হলো, আমরা অনেক দেরি করে রাতে খাই এবং খেয়েই শুয়ে পড়ি। এটিও কিন্তু কণ্ঠনালির জন্য ভালো নয়। হাইপার অ্যাসিডিটি আছে এমন (ল্যারিঙ্গো ফ্যারিঞ্জাল রিফ্লাক্স ডিসিজ) রোগীদের গলার আশপাশে প্রদাহজনিত কারণে ভোকাল কর্ড/কণ্ঠনালি ফুলে যায়। তাদের ক্ষেত্রে রাতের খাবার খাওয়ার পর অন্তত দুই ঘণ্টা পর শুতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘুমানোর সময় মাথা যেন শরীরের তুলনায় একটু উপরের দিকে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঝাল খাবার বর্জন করতে হবে। ঝাল থেকে বেড়ে যায় পাকস্থলীর অ্যাসিড। আর অ্যাসিডিটির জন্যও গলার স্বর ভেঙ্গে যেতে পারে।

৬. কণ্ঠনালিরও বিশ্রাম দরকার। আমরা অনেক সময় বিরতি ছাড়া কথা বলে যাই; চিন্তা করি না স্বরযন্ত্রও একটি যন্ত্র। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অনেক সময় একই রকমভাবে টানা কথা বলতে দেখা যায়। কণ্ঠেরও রেওয়াজ বা ব্যায়াম দরকার। এছাড়া শারীরিক ক্লান্তিও কণ্ঠস্বরের ওপর মন্দ প্রভাব ফেলে থাকে।

৭. তিন সপ্তাহের অধিক গলাভাঙা থাকলে অবহেলা করবেন না। দীর্ঘস্থায়ী স্বরভঙ্গের যে কারণ নিয়ে আমরা সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, সেটি হলো কণ্ঠনালির ক্যানসার। এটি আমাদের দেশে ক্রমেই বাড়ছে। তাই কারও যদি স্বরভঙ্গ তিন সপ্তাহের বেশি থাকে, তাহলে অবশ্যই নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন। নাক-কান-গলা রোগের চিকিৎসকরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে ভোকাল কর্ড বা কণ্ঠনালি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে : ইনডাইরেক্ট ল্যারিংগোস্কপি, ভিডিও ল্যারিংগোস্কপি। কণ্ঠস্বরের পরিবর্তনে ব্যক্তির রোগের ইতিহাস, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রাথমিক পর্যায়ে গলা ভাঙার কারণ নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জীবিকা অর্জনের জন্যও আইনজীবী, শিক্ষক, ইমাম, উপস্থাপক, অভিনয়-বাচিক ও কণ্ঠশিল্পীদের সুন্দর কণ্ঠ প্রয়োজন। তাই স্বাভাবিক সুন্দর দিন যাপন, এমনকি জীবিকা অর্জনের জন্যও সুস্থ সুন্দর কণ্ঠের বিকল্প নেই। একটু সচেতনতাই আমাদের কণ্ঠকে সমূহ ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে।

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী : নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ; হেড-নেক সার্জন, রেজিস্ট্রার, নাক-কান-গলা বিভাগ; সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম