আজ বিশ্ব পানি দিবস। এ বিষয়টি সম্পর্কে খুব বেশি আলোচনা না হলেও বর্তমান বিশ্বে গুরুত্ব বিচেনায় এটি প্রথম সারির বিষয়। পানির সঙ্গে সবাই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। কিন্তু এটি যেহেতু আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় বিনামূল্যে পাচ্ছি, তাই এ নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। পানির অপর নাম জীবন এটি আমরা সবাই জানি। তবে বর্তমানে পানির সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে, যা হলো সুপেয় পানি। আমাদের ব্যবহারের পানি অযোগ্য হয়ে পড়ছে দিনদিন। আমাদের মতো জনবহুল দেশের জন্য এটি অতি চিন্তার বিষয়।
পানি দিবস নিয়ে আলোচনার আগে আমাদের জেনে নেওয়া দরকার দিবসটি সম্পর্কে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। পরে ১৯৯৩ সালে পানির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য জাতিসংঘ ২২ মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে দিবসটি পালনের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ দিনটিকে নিজ নিজ দেশে জাতিসংঘের পানিসম্পদসংক্রান্ত সুপারিশ ও উন্নয়ন প্রস্তাবগুলোর প্রতি মনোনিবেশের দিন হিসাবে উৎসর্গ করে।
সরকার পানিসম্পদ রক্ষা করার জন্য এ দিবসটিতে বিশেষ বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। তবে মূল বিষয় হলো পানিসম্পদ রক্ষা করার জন্য এ দিবসটিকে যে পরিমাণ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, আমার মনে হয় তা দেওয়া হয় না। এ দিবসটি বর্তমানে যে গুরুত্ব বহন করছে, সে পরিমাণ কার্যক্রম দেখা যায় না।
পানি হচ্ছে অমূল্য সম্পদ। প্রাণিকুল রক্ষায় পানি দূষণমুক্ত রাখার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবছরই বিশ্ব পানি দিবসে সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার হওয়া উচিত পানির সঠিক ব্যবহার নিয়ে। পানিদূষণ বলতে পানির গঠনগত ও অবস্থানগত এমন পরিবর্তনকে বোঝায়, যাতে পানি স্বাভাবিক অবস্থায় জীবজগতের যেসব কাজে বা উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো, সেসব কাজের জন্য অনুপযোগী থাকে এবং জীবনরক্ষার চেয়ে জীবনকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। পানিদূষণের বিষয়টি এখন শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই মুখে বললেও এর জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। সবার অবস্থানটা এরকম যে, এ সমস্যাটা কেবলই নিজের। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে এর সঠিক কারণ আগে খুঁজে বের করে তা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে কারণগুলো জানা থাকলেও তা সমাধানের খুব একটা চেষ্টা করা হচ্ছে না বলেই মনে হয়। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে পানির চাহিদা। কিন্তু বাড়ছে না সুপেয় পানির পরিমাণ। সমুদ্র, নদী-নালা ও হ্রদ আমাদের পানি জোগানের অন্যতম উৎস।
কিন্তু এসব উৎসকে আমরা এমনভাবে ব্যবহার করছি যেন ভবিষ্যতে আমাদের আর পানির দরকার হবে না! স্পেস ব্লগ সাইট থেকে জানা যায়, ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭০ শতাংশ পানি দ্বারা আবৃত। তবে পৃথিবীর মোট পানির ৯৭ শতাংশ সমুদ্র এবং মহাসাগরের এবং মাত্র ৩ শতাংশ স্বাদু পানি। এর মধ্যে আবার ২ শতাংশ কঠিন আকারে এবং ১ শতাংশেরও কম ব্যবহার উপযোগী। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পয়ঃপ্রণালির আবর্জনা, শিল্পের আবর্জনা, মানুষ দ্বারা প্রত্যক্ষ দূষণ, কঠিন আর্বজনা, কীটনাশক ও আগাছানাশক ওষুধ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, অ্যাসিড, খনিজ তেল পানিদূষণের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে পয়ঃপ্রণালির ক্ষতিটা হচ্ছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেশি। মলমূত্র ও বর্জ্য পদার্থ নদীতে গিয়ে এমনভাবে পড়ছে, যার ফলে ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে অজৈব পদার্থে পরিণত হচ্ছে পানি। এর ফলে ক্রমান্বয়ে নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ মারা যাচ্ছে ও বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হচ্ছে।
ইদানীং শিল্পকারখানার উত্তপ্ত বর্জ্যপদার্থ পানিতে নির্গত হওয়ার ফলে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পানির অক্সিজেন ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত আর্সেনিক পানিতে মিশে থাকে। এসব ক্ষতিকর উপাদান পানিকে দূষিত করছে। এ ছাড়াও মানুষ প্রত্যক্ষভাবে পানিতে গোসল ও বস্ত্রাদি ধৌত করার ফলে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মিশে পানির দূষণ বাড়ছে। অন্যদিকে পলিথিন, রাবার, প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি পণ্য যা সহজেই নষ্ট হয় না, তা পানিতে জমে দূষণের কারণ হচ্ছে।
কৃষিপ্রধান দেশে আমাদের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত উৎপাদন বৃদ্ধির চিন্তা করতে হয়। আর এ জন্য ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার করছে কৃষক। এসব ওষুধ মাটির সঙ্গে থাকা পানিতে মিশে যাচ্ছে এবং এ পানি জলাশয়ে গিয়ে পতিত হচ্ছে; যার ফলে দূষিত হচ্ছে পানি। বর্তমানে বিশ্বে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে গাড়ির ব্যবহার এবং আণবিক শক্তি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন পরমাণু ও তেজস্ক্রিয় আইটোসেপের ব্যবহার। এসব পদার্থ বৃষ্টির পানিতে মিশে পানির উৎসগুলোতে পতিত হচ্ছে, যার ফলে পানি হয়ে পড়ছে ব্যবহারের অযোগ্য।
বস্তুত প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে আমরা এ প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করছি; কিন্তু এ থেকে মুক্তির উপায় বের করছি না, বের করলেও এ লক্ষ্যে কাজ করছি না। এ অবস্থা থেকে মুক্তির যেসব উপায় রয়েছে তার জন্যও যথেষ্ট চেষ্টা করছি না। যেসব কারণে আমাদের এ মহামূল্যবান পানি নষ্ট হচ্ছে এবং এর ফলাফল কী হচ্ছে, সেসব নিয়েও আমাদের কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। কেবল এ দিবসটিতে একটি ব্যানার টানিয়ে সচেতনতার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি। মনে রাখতে হবে আমাদের জীবনধারণের জন্য পানি একটি অত্যাবশকীয় উপাদান। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে সুপেয় পানির কোনো বিকল্প নেই। তাই পানির সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি। সারা বছর এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি অন্তত বিশ্ব পানি দিবসে পানিদূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। পানির এ দূষণ রোধ করতে না পারলে আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের একটি অনিরাপদ পৃথিবী রেখে যেতে হবে।
আমরা যত সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, দূষণের ভয়াবহতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে এ সমস্যাটাকে আমরা কখনো নিজের মনে করছি না। তাই এর দূষণের মাত্রা কমানোর জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। পৃথিবীর পানি নিরাপদ রাখার জন্য একক প্রচেষ্টায় সঠিক ফল না আসাই স্বাভাবিক। তাই এর জন্য বিশ্বব্যাপী একটি সঠিক আইন তৈরি এবং সে আইনের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে পানিকে নিরাপদ রেখে একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলাই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিশ্বনেতাদের উচিত এটিকে কোনো নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা হিসাবে বিবেচনা না করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সারা পৃথিবীর সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা।
নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী
nilmajumdar81@fmail.com