Logo
Logo
×

বাতায়ন

কত আর কাটছাঁট করে চলবে মানুষ?

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কত আর কাটছাঁট করে চলবে মানুষ?

উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে স্বল্প-আয়ের মানুষ অগত্যা সবজিতেই ভরসা রাখছে বলে আমার একটি নিবন্ধ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে কিছু সবজির দাম চড়া। যেমন করলা। করলা ফলিয়ে কিছু এলাকার চাষি নাকি ভালো মুনাফা করছে। স্বচ্ছভাবে ব্যবসা করে কেউ মুনাফা করলে সেটি অভিনন্দনযোগ্য। মুনাফার সুযোগ না থাকলে আজকাল কৃষিকাজেও লোকে শস্য বদলায়, চাষের ধরন বদলায়। মুনাফা করতেই ধানিজমি কেটে মাছচাষ শুরু করেছে অনেকে। একযোগে অনেকে মাছচাষে ঝুঁকে পড়লে আবার অতি-উৎপাদনের সংকট তৈরি হয় এবং লাভজনক দাম পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কৃষিতে অনেক ক্ষেত্রে ছোট ও মাঝারিরা নিজের উদ্যোগ ও শ্রমকে বিবেচনায় না নিয়ে উৎপাদন ব্যয় হিসাব করে এবং মুনাফায় আছে ভেবে আনন্দ পায়। প্রকৃতপক্ষে সে হয়তো লোকসানে আছে।

কথা হচ্ছিল করলা চাষিরা লাভ করছে-এরকম খবরের ওপর। আজকাল সবজিতে হাইব্রিড বীজের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। এতে ফলন যেমন বাড়ছে, তেমনই মৌসুম নিরপেক্ষভাবে অনেক সবজির চাষ হচ্ছে। গ্রীষ্ম ও শীতকালীন সবজির বিভাজন উঠে যাচ্ছে ক্রমে। ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে, করলার মতো সবজির নির্দিষ্ট কোনো মৌসুম নেই। এখন যেমন কমবেশি সারা বছরই লাউ পাওয়া যায়। তবে আবহাওয়ার একটা প্রভাব রয়েছে উৎপাদনে। সেজন্য বিশেষ মৌসুমে সবজির প্রাপ্তি ও দামে তারতম্যের ব্যাপারে রয়েছে। স্বাদের প্রশ্নও আছে। মোদ্দা কথা, মৌসুমের শুরুতে যে সবজি ওঠে, তার দাম একটু বেশিই হবে। মৌসুমের শুরুতে যে টমেটো, এমনকি আলু ওঠে বাজারে, তার দাম থাকে অতিশয় বেশি। কিন্তু সেটি বড় খবর নয়। দু-একটা সবজির দাম বেশি হলে তো কিছু যায়-আসে না। অন্যান্য সবজি বাজারে রয়েছে। বেশি দামে নতুন ওঠা সবজি কেনার লোকও দেশে কম নেই। মাঝে সম্ভবত বাণিজ্যমন্ত্রী কথাটি বলেছিলেন যে, ৪-৫ কোটি লোক আরামে আছে। ১৭ কোটির দেশে ৪-৫ কোটি লোক সচ্ছল জীবনযাপন করলে সেটি কম নয়। প্রশ্ন হলো, মধ্যবিত্তের একাংশ চলমান মূল্যস্ফীতির চাপে এবং এর মধ্যে আয় বাড়াতে ব্যর্থ হয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত হয়ে পড়ছে কিনা। মোটামুটি দীর্ঘ করোনাকালে অনেকেরই এমন শ্রেণিচ্যুতি ঘটেছে। এর চাপে পড়ে বহু লোক গ্রামের দিকে চলে গেছে। অনেকে পরিবার পাঠিয়ে দিয়ে নিজে থেকে গেছে উপার্জনের কেন্দ্রস্থলে। তাদের অনেকে এখন স্থিতাবস্থা ধরে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত।

করোনা কেটে যাওয়ার পর বাজারে নতুন যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তাতে আবার নবতর সংকটে পড়েছে নিম্ন-আয়ের মানুষ। তারা ইতোমধ্যে ব্যয় সংকোচন শুরু করে দিয়েছে। সরকার যেমন অর্থসংকটে পড়লে অপ্রয়োজনীয় খাতে কমিয়ে জরুরি খাতে ব্যয় অব্যাহত রাখতে চায়-চ্যালেঞ্জে পড়া মানুষও তেমন আচরণ করে নিজের জীবনে। শুরুতেই ভ্রমণ ব্যয় বাদ দেয়। বিলাসী কেনাকাটা কমায়। দাওয়াত করে খাওয়ানোও কমিয়ে দেয়। এমনকি উপহার দেওয়াটা এড়ায়। এভাবে এগোতে এগোতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং নিয়মিত খাদ্য গ্রহণেও কাটছাঁট শুরু করে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক পরিস্থিতি হয় যখন মানুষ শিশুসন্তানের দেখভালেও ব্যর্থ হয়। বহু পরিবারে সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে খাদ্যসামগ্রীর দাম বেশি হারে বাড়ার সঙ্গে শিক্ষা উপকরণ, বিশেষত কাগজের দাম অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায়। যাদের অল্পবয়সি শিশু রয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার সামগ্রী ও শিশুখাদ্য যেমন গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে লাফিয়ে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেই কিন্তু বেড়েছিল সাবান-শ্যাম্পু-টুথপেস্ট ইত্যাদির ব্যবহার। মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নির্ভরতা বেড়েছিল গুঁড়া সাবান ও বার সাবানের ওপর। সেগুলোর দামও কতটা বেড়েছে, তা সবার জানা। ওষুধের দামও নীরবে বাড়ছে। অনেক ডাক্তার ফি বাড়িয়েছেন এবং প্যাথলোজিক্যাল ল্যাবে বেশকিছু টেস্টের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ অবস্থায় অনেকে নিশ্চয়ই ছয় মাস বা এক বছরে আগে যেমন ডাক্তার দেখাত এবং কিছু প্রয়োজনীয় টেস্ট করাত, সেগুলো বাদ দেবে।

এ প্রক্রিয়ায় নিম্ন-আয়ের লোকজন খাদ্যগ্রহণে কঠিন কাটছাঁটে চলে গেছে। গরু ও খাসির মাংস তারা আগেও তেমন খেত না। হয়তো শখ করে খেত। এখন এটি পুরোই বাদ। ব্রয়লার ও ডিমের ওপর যারা নির্ভরশীল ছিল, তারা সবজির দিকে ঝুঁকবে। পেট ভরানোটাই কথা এখন বহু মানুষের। আটা-ময়দার দাম অতিমাত্রায় বেড়েছে বলে লোকজন বেশি করে ভাত খাচ্ছে, এমন একটা খবর মাঝে মিলেছিল। চালের দামও কিন্তু বেড়ে চলেছে। চালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, এটি অনেকদিন ধরেই বলা হচ্ছে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমরা যে আর স্বয়ংসম্পূর্ণ নেই, সেটা বোঝা যাচ্ছে আমদানির চিত্র দেখে। সরকারিভাবেও চাল আমদানি হচ্ছে এবং নামমাত্র দামে আরও বেশি লোকের মধ্যে চাল বিতরণের কর্মসূচি আছে। সামনেই অবশ্য বোরো মৌসুম। এটাকে বিপুলভাবে সফল করা গেলে হয়তো চালের দামে ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যাবে। তবে মনে হয় না, দাম আগের অবস্থায় আর ফিরবে।

কোনো পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেই তার দাম কম থাকবে, এমন কোনো কথা কিন্তু নেই। চালের পাশাপাশি এক্ষেত্রে মাছ ও গো-মাংসের কথা বলতে পারি। এগুলোয়ও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করা হয়। কিন্তু মাছের দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও গো-মাংসের দাম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাড়তে বাড়তে এটি কেজিতে ৭০০ টাকায় স্থিতিশীল হয়েছিল। সম্প্রতি ৮০০-র দিকে যাচ্ছে এবং সম্ভবত রমজান আসতে আসতে গো-মাংসের দাম ৮০০ টাকায় স্থিত হবে। এ অবস্থায় ব্রয়লারের দাম আগের জায়গায় থাকলে তা-ও লোকে আমিষের ঘাটতি কিছুটা পূরণ করতে পারত। সঙ্গে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকলে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, উৎপাদন পর্যায়েও এগুলোর দাম লাফিয়ে বাড়ছে। চাষের মাছেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এসব খাতে উৎপাদন ব্যয় আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। মৎস্য ও পশুপালন খাতের ফিডে যেসব উপকরণ লাগে, সেগুলোর দাম বেড়ে গেছে। ছোট বেশকিছু খামার নাকি উঠে গেছে ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে। তার মানে, সরবরাহে একটা সংকট রয়েছে। ধান-চালেও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। সারে কমানো হয়েছে ভর্তুকি এবং ডিজেলের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। সরকারের পক্ষে এসব খাতে ভর্তুকি আগের মতো চালিয়ে যাওয়া নাকি সম্ভব নয়। আগামী দিনে দেশে একটা দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতে পারে বলে এক ধরনের প্রস্তুতি রাখার কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, সরকার সে শঙ্কা মোকাবিলায় কিছু করবে না।

সরকার কী করছে, তার একটা প্রমাণ পাওয়া যাবে অচিরেই রমজানের বাজারে। এ সময়ে নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যপণ্যের দাম প্রতিবছরই অনেক বাড়তে দেখা যায়। চাহিদার হঠাৎ বৃদ্ধির কারণেও এটি হয়ে থাকে। অবস্থাপন্ন লোকজন একযোগে অতিরিক্ত কেনাকাটা করে ঘরে মজুত করাতেও দাম বৃদ্ধির সমস্যা দেখা দেয় বলে মত রয়েছে। এবার সেটা আরও বেশি করে ঘটতে পারে এজন্য যে, কিছু পণ্যের সরবরাহে বড় ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে খোদ ব্যবসায়ী মহল থেকে। যেমন, এ সময়ে অনেক বেড়ে যাওয়া চাহিদার পণ্য চিনির ঘাটতি রয়েছে। মুশকিল হয় তখন, যখন পণ্যটি দেশে উৎপন্ন হয় না; ৯৫-৯৭ শতাংশই আমদানি করতে হয় এবং যখন আমদানিও উচ্চ দাম ও ডলার সংকটে কঠিন হয়ে পড়ে। রমজানে আমরা বেশি করে খেজুর খেতেও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এর আমদানিতেও সংকট রয়েছে। আপেলসহ আমদানি করা ফলের চাহিদাও তখন বাড়ে। দেশি ফল, যেমন পেয়ারা-বরই ইত্যাদি দিয়ে এটাকে কতটা প্রতিস্থাপন করা যাবে জানি না। তবে এগুলোও বড় খবর নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-আয়ের মানুষ বেশি করে দেখতে চায়, চাল-ডাল-তেল-লবণ-মরিচ ইত্যাদির দাম স্বাভাবিক আছে কিনা। গো-মাংস না হলেও তাদের চলবে; তবে তারা চায় ব্রয়লার ও বাদামি ডিমের দামটা নিয়ন্ত্রণে থাকুক। চাষের মাছের দাম সহনীয় থাকুক। দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী কিন্তু তিন বেলায়ই ভাত খেয়ে থাকে এখনো। মাঝে তাদের মধ্যে আটা-ময়দার রুটি ও বেকারি পণ্য পাউরুটি প্রবেশ করেছিল। সেখান থেকে তারা আবার ভাতের দিকে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মোটা ও মাঝারি চিকন চালের দাম কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, সেটা বড় পরীক্ষা। দু-একটি নতুন সবজির কথা বাদ দিলে সাধারণভাবে সবজির বাজার কিন্তু সহনীয় রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকে কেবল খেয়াল রাখতে হবে, মাঠ পর্যায়ে থেকে সাপ্লাই চেইনটি যেন স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। আমাদের বাজার ব্যবস্থায় হাতবদল বেশি বলেও অনেক পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। সব পক্ষকেই তো কমবেশি মুনাফা করতে হবে। কোনো কোনো পক্ষ আবার বেশি মুনাফা করতে চায়। সরকার থেকে বেশি চাপাচাপি করেও এ প্রবণতা রোধ করা যাবে না।

এফবিসিসিআই সভাপতি তাদের এক সভায় সম্প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, ব্যবসায়ীরা এবার নতুন অভ্যাস চর্চা শুরু করবে রমজানে দাম কম রাখার। অনেক মুসলিম দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ অভ্যাস রয়েছে। আমাদের এখানে এটি এত দীর্ঘ সময়েও গড়ে ওঠেনি কেন, তা অনুসন্ধানের বিষয়। তবে প্রায় বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার এ সময়টায় বাংলাদেশের অতিমুনাফাপ্রবণ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে ওই অভ্যাসের চর্চা শুরু হবে বলে আশা করা ঠিক নয়। আমরা বরং চাইব, সরকার জরুরি পণ্যসামগ্রীর আমদানি স্বাভাবিক রাখতে সবরকম প্রচেষ্টা নেবে এবং দেশে যেসব পণ্যসামগ্রী উৎপন্ন হয়, সেগুলোর সাপ্লাই চেইন অটুট রাখতে তৎপর হবে। কোনো কোনো পণ্য সরবরাহে অল্পকিছু করপোরেট গ্রুপের আধিপত্য রয়েছে। সেখানে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার প্রবণতা থাকতে পারে। এটি বড় সংকটের জায়গা। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ কিছু খাদ্যপণ্যের দাম কমে আসার খবর অবশ্য রয়েছে। এর স্বাভাবিক সুফল ব্যাপক ভোক্তাসাধারণ না পেলে সেজন্য কিন্তু সরকারকে অভিযুক্ত হতে হবে।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম