Logo
Logo
×

বাতায়ন

পাঠকের আস্থা ধরে রাখতে হবে

Icon

অমিত রায় চৌধুরী

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পাঠকের আস্থা ধরে রাখতে হবে

সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশে প্রিন্ট মিডিয়ার ভূমিকা সব সময়ই নির্ণায়ক ছিল। মানুষের বৌদ্ধিক মনোভূমি আগাগোড়াই শাসন করেছে যুক্তি। তার প্রেরণাই হলো ঐক্য ও শৃঙ্খলার বোধ। জনমানসে তাই ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষা প্রবল। কর্তৃত্ব বা আদর্শবাদী যে কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘোষিত লক্ষ্যই হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

অনেকে মনে করেন, কিছু দুর্বলতা সত্ত্বেও হয়তো এখনো গণতন্ত্রই সর্বোত্তম পন্থা, যা কালের পরম্পরায় নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। নতুন করে তৈরি হয়েছে নাগরিকতাবোধ। সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীন মতপ্রকাশের জোরালো আকাঙ্ক্ষা। রাষ্ট্র-ধারণায় যুক্ত হয়েছে অংশীদারত্ব। রাষ্ট্রের মালিকানাবোধও গড়ে উঠেছে আমজনতার।

সপ্তদশ শতকে খবরের কাগজ চালু হয়। তবে তার প্রসার ঘটে আঠারো ও উনিশ শতকে। বড় বড় শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সংবাদপত্র পাঠে মানুষ অভ্যস্ত হতে শুরু করে। তবে এ কথা সত্য, সংবাদপত্রের সূচনার সঙ্গে সঙ্গেই সাংবাদিকদের বিপন্নতাও শুরু হয়েছিল। জেমস অগাস্টাস হিকির কারাদণ্ডই তার প্রমাণ।

সাংবাদিকদের প্রতি শাসক দল খুব সদয় থেকেছে-এমন প্রমাণ হয়তো ইতিহাসে বড় একটা পাওয়া যাবে না। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা-সবখানেই খবরদারির অভিযোগ পাওয়া যায়। পেন্টাগন পেপারসকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য ওয়াশিংটন পোস্টকে উচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ও তার প্রয়োগ নিয়ে আমাদের দেশেও উদ্বেগের অন্ত নেই। পক্ষে-বিপক্ষে নানা তর্ক আছে। তবুও এ কথা সত্য, গণতান্ত্রিক সমাজ যেভাবে ভিন্নমতকে সহ্য করে, স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী তা করে না। যে অঙ্গীকার নিয়েই তারা ক্ষমতা দখল করুক না কেন, মসনদ পোক্ত করতে তারা ভিন্ন স্বরকে দমন করে। এটি ইতিহাস নির্ধারিত সত্য।

আধুনিক যুগে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হলো গণমাধ্যম। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনই গণমাধ্যমের প্রাথমিক কাজ। গণমাধ্যমই সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে। ধ্রুপদি গণতন্ত্রেও চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে গণমাধ্যম পরিচিত। সত্যি বলতে কী, গণমাধ্যম কীভাবে কাজ করছে, তা বিচার করেই রাষ্ট্র সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে ওঠে। প্রাক-উপনিবেশ যুগে সুসংহত রাষ্ট্র-ধারণা ছিল না।

দেশবিভাগ-উত্তর জনমানসে তা একটা বড় জায়গাজুড়ে অবস্থান করেছিল। তবে সে ব্যবস্থা বিত্তবান আলোকপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করেই পথ চলেছিল। আমজনতার সঙ্গে তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থার যোগসূত্র ছিল খুবই দুর্বল। গণমাধ্যম ঠিক তখনই বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে সেই ব্যবস্থার অংশীদার হয়ে পড়ে। বৃহত্তর সমাজের স্বার্থে ন্যায্যতা অবলম্বন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ধারণাকে অর্থবহ করে তোলে।

তবে বিগত চার দশকে খোলাবাজারের প্রভাব গণমাধ্যমের চরিত্রকে বদলে ফেলে। পালটে যায় সংবাদমাধ্যমের পেশাদারি মূল্যবোধ। বাজারের অ্যালগরিদম মেনে যুক্তিকে পেছনে ফেলে সামনে উঠে আসে জনপ্রিয়তার বোধ। তথ্য নয়, নতুন রুচি আর সেই মোতাবেক চাহিদা। এ প্রতিযোগিতায় ফিকে হয়ে আসতে থাকে প্রিন্ট মিডিয়া, যা বৌদ্ধিক চিন্তন প্রক্রিয়া দ্বারা চালিত। আর তা পরিকল্পিত ও সমাজের জন্য চূড়ান্ত অর্থে হিতকর, আদর্শনির্ভর।

আধুনিক যুগের মানুষের হাতে সময় কম। বিশ্লেষণ ব্যাখ্যার চেয়ে সংক্ষিপ্ত তথ্যই বেশি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তা প্রহরাহীন হওয়ায় এ প্ল্যাটফরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সংবাদ যাচাইয়ের সুযোগ এখানে খুবই কম। তাই গুজব বা বিদ্বেষের বীজ বুনে সমাজকে অস্থির করার এ অস্ত্র মতলববাজদের হাতে সহজেই চলে যায়। কারণ, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক তথ্য জনমতকে অনায়াসে প্রভাবিত করতে পারে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়ার পপুলিস্ট উত্থানকে কি সহজে কাবু করা যাবে? বল্গাহীন খবরের অবিরাম স্রোত কি আদৌ দুর্বল হয়ে আসবে?

একটা সময় ছিল, কাগজে লেখা হলেই তার সত্যতা নিয়ে সংশয় থাকত না। ছাপা অক্ষরই যেন সত্যের সাক্ষ্য। পরিস্থিতি এখন তেমন নেই। কাগজটি স্বাধীন-নিরপেক্ষ কিনা অথবা কোনো দলের বা মতের মুখপত্র কি না-এমন প্রশ্নও পাঠকের মনে উঁকি দেয়। ‘মানুষ আজকাল ছাপা কাগজ পড়ে না’-এমন ধারণা বোধহয় ঠিক নয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এখনো পাঠকের একটা বড় অংশের আস্থা খবরের ছাপা অক্ষরে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না পড়লে তাদের মন ভরে না। তবে কেন সংবাদপত্র সামাজিক মাধ্যমকে এতটা জায়গা ছেড়ে দিল বা ছাড়তে বাধ্য হলো, তা ভেবে দেখতে হবে। বিজ্ঞাপনের লোভ না বাজারের প্রভাব, নাকি রাজনৈতিক মতাদর্শ-কোন কারণে সামাজিক মাধ্যম এতটা জায়গা পেয়ে গেল।

দেখা যাবে এখন নানা কারণে প্রিন্ট মিডিয়ার টিকে থাকার পথে বড় অন্তরায় সৃষ্টি করছে সোশ্যাল মিডিয়া। অনেক মানুষ একসময় একসঙ্গে তাদের পছন্দের কোনো একটি বিষয়ে তাৎক্ষণিক মতপ্রকাশ করতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এমন বৃহত্তর নাগরিক অংশগ্রহণ জন-আকাঙ্ক্ষাকে তুষ্ট করতে পারছে। আবেগী প্রতিক্রিয়া প্রকাশের নতুন এ জানালা প্রবৃত্তিগতভাবেই মানবমনে হয়তো জায়গাও পেয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান বলে, ভালো ও রুচিসম্পন্ন সংবাদের চাহিদা তৈরি হয় মস্তিষ্কে। আর এ চাহিদা তৈরি করা সংবাদপত্রেরই কাজ-যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধিকার আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, গণ-অভুত্থান, ভাষাযুদ্ধ। সবখানেই প্রমাণ হয়েছে সংবাদপত্র কীভাবে জনমতকে সংগঠিত করতে পারে।

প্রিন্ট সাংবাদিকদের এখন সাম্প্রতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টারনেট। বিনামূল্যে যে কোনো সময় খবরের কাগজটা পড়ে নেওয়া যায়। প্রিন্ট সাংবাদিকদের রুজি-রোজগার সহসাই তখন বিপন্নতার পথে পা বাড়ায়। সবচেয়ে বড় বিপদ দেখা দেয় তারা যখন তথ্যনির্ভর সংবাদের চেয়ে গুরুত্ব দেয় এমন সংবাদের প্রতি, যা বিজ্ঞাপন আকর্ষণ করে। খবরের কাগজের বিশ্বাসযোগ্যতা তখনই কমতে শুরু করে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে কোণঠাসা এ শিল্পের বিপর্যয় নীরবে ঘনিয়ে আসে। মালিকানা চলে যায় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে। শাসকও বিজ্ঞাপনের এ অস্ত্র ব্যবহার করে। আনুগত্য কিনে নেওয়ার সহজ উপায় হাতে এসে যায়। অথচ শাসকের দোষত্রুটি প্রচার করাই সংবাদমাধ্যমের কাজ। গণমাধ্যমের মূল আদর্শ সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা অর্থাৎ বস্তুনিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন। সাংবাদিকরাই একদিন গণতন্ত্রকে মজবুত করেছিল, শাসককে সংশোধন করেছিল।

সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন সৃষ্টি উত্তর সত্য, যা মনুষ্যত্বকে বাতিল করে আবেগকে মনোজগতে ভাসিয়ে রাখে। সমষ্টিগত ধারণা ও বিশ্বাসকে পরিবর্তন করে। খবরের যুগোত্তীর্ণ মূল্যবোধ প্রহসনে পরিণত হয়। তাহলে সংবাদটা কী? সত্যকে অবিকৃতভাবে উপস্থাপন করা। জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া। চমক সৃষ্টি সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়। তাৎক্ষণিক সুবিধা পেলেও দিনশেষে আস্থা হারায় সংবাদপত্র। পাঠকের সস্তা চাহিদা অগ্রাধিকার ঠিক করলে গণমাধ্যম পরাজিত হয়।

যুগান্তর দুই যুগে পদার্পণ করেছে। মহাকালের মানদণ্ডে এ সময় একটি ক্ষণ মাত্র। দেশের বয়স পঞ্চাশ। জাতির জীবনে এ সময়টি কম নয়। এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে আমাদের দেশ। একটি জাতিরাষ্ট্রের বৈপ্লবিক উত্থান। জাতির পিতার কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড। নতুন রাষ্ট্রের দর্শনকে বদলে ফেলার চক্রান্ত। আবার রুখে দাঁড়ানো। বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কূটনৈতিক সাফল্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার। বিশ্বসভায় দেশের মুখ এখন অনেকটাই উজ্জ্বল। স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক দেশ যে সংশয় প্রকাশ করেছিল, তা আজ অসার প্রমাণিত। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য ও অসাম্যের প্রবল আগ্রাসন রুখে দিয়ে দেশ পেরিয়েছে অনেক পথ। আর এসব পরিবর্তনের দিকচিহ্নগুলো বহন করছে সংবাদপত্র। পত্রিকার এটাই ধর্ম, এটাই বৈশিষ্ট্য।

যুগান্তর ইতিহাসের যে সময়সন্ধিতে সরব থেকেছে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দেশ তার অন্তর্গত প্রতিরোধী শক্তির প্রমাণ দিয়ে পাহাড়সমান প্রতিকূলতাকে জয় করেছে। গণতন্ত্র যখন দেশে দেশে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে, গণমাধ্যম তার স্বকীয়তা, নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হিমশিম খেয়েছে, যুগান্তর তখন পাঠকের আস্থাকে আগলে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন ধারা, মত ও দৃষ্টিকোণকে উদারভাবে আশ্রয় দিয়ে কাগজটি টিকে আছে অনেক সাফল্য, অনেক গৌরব নিয়ে। জনমত সংগঠনে এমন সংবাদপত্রের ভূমিকা আজও অগ্রগণ্য।

চলার পথে বাঁক থাকবেই। কিছু বাধা আসবেই। তা অতিক্রম করার শক্তি নিজেকেই অর্জন করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা দল নয়, গণতন্ত্রের মূল সূত্রটির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থাকবে। বহুত্বকে আমরা যেন সম্মান করি। যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদার নীতিবোধকে যেন আমরা সমুন্নত রাখি। সত্যের সাধনায় আমরা যেন পথভ্রষ্ট না হই। কেবল অর্থনীতির শক্তিতে নয়, একটা বহুত্ববাদী মানবিক উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে মানানসই এমন সংবেদী, দক্ষ সমাজ গঠনে যুগান্তর এগিয়ে চলুক সময়ের স্রোতে ভেসে-এমনই প্রত্যাশা আমাদের।

অমিত রায় চৌধুরী : ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম