পুস্তকাকারে সংকলিত বিভিন্ন তথ্যকে সাধারণত জ্ঞান (knowledge) বলা হয়। এতে প্রকৃতি, ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, কারিগরি, বিজ্ঞান, বিভিন্ন ঘটনাবলি ও আবিষ্কার লিপিবদ্ধ করা হয়।
আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের মূলত এ জ্ঞানের ভিত্তিতে মূল্যায়ন ও ডিগ্রি দেওয়া হয়। সমাজ ও জাতীয় কার্যাবলী পরিচালনায় জ্ঞান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অন্যদিকে প্রজ্ঞা (wisdom) আত্মোপলব্ধি ও আত্মচেতনা থেকে উদ্ভূত জীবন্ত নির্দেশনা, যা আত্মপ্রত্যয় ও কর্মোদ্দীপনার মূল উৎস।
দেশ ও জাতির নেতৃত্বে ও সব সৃষ্টির কল্যাণে মানুষের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা ছাড়া চলমান বিশ্বের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। দূরদর্শিতা মানুষকে দেওয়া স্রষ্টার একটি মূল্যবান গুণ, যা না থাকলে দেশের জনগণকে সঠিক পথে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। এ বিশেষ মানবিক গুণ নেতাকে ভবিষ্যৎ দেখার অন্তর্দৃষ্টি দেয়, যা জাতির বিশেষ সংকটকালে জনগণকে আত্মরক্ষা করার পথ দেখায়। নেতার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অভাবে একটি দেশে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি একটি সত্যিকার ঘটনার অবতারণা করতে চাই। এ আলোচনার মাধ্যমে আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস কীভাবে ব্যক্তি থেকে জাতীয় পর্যায়ে প্রসারিত ও প্রচারিত হয়ে একটি জাতিকে প্রকৃতির নানা ধরনের বাধা অতিক্রম করার বাস্তব জ্ঞান, মনোবল ও বুদ্ধির সঞ্চার করে তা বোঝা যাবে।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের রাতে এক ভয়াবহ সাইক্লোন চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে আঘাত হানে। এ ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার, সঙ্গে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস, যা চকোরিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণসহ প্রায় ১০ লাখ মানুষকে বসতিহীন করে। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, পশু-পাখি, গাছপালা নির্বিশেষে কাউকে রেহাই দেয়নি।
কাজেই, এ পৃথিবীতে কাউকে যেমন ধর্মের মোহর দিয়ে পাঠানো হয়নি, তেমনি প্রকৃতির ছোবল থেকে নিজেদের রক্ষা করার প্রচেষ্টা ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবার সম্মিলিত উদ্যোগেই চালাতে হবে।
বাংলাদেশের এ প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে আমি পরিবারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে বসবাস করতাম। টিভিতে এ খবর জেনে আমার মন উতলা হয়ে ওঠে। মনের ভেতর এক শোকের ছায়া আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমি ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের কয়েকজন নামকরা আবহাওয়া বিশেষজ্ঞের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। আমি তাদের আমার পরিচিতিতে বাংলাদেশের একজন নাগরিক ও প্রতিনিধি (আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী) হিসাবে পরিচয় দিয়ে আমার মনের আবেগ ও দুঃখ প্রকাশের পর জানতে চাই আমাদের সীমাবদ্ধতা কী এবং জাতি হিসাবে আমাদের করণীয় কী। বিশেষজ্ঞরা বললেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তরের কারিগরি দক্ষতা আমাদের সমকক্ষ এবং তাদের যন্ত্রপাতি, ভূ-উপগ্রহ ও আনুষঙ্গিক কম্পিউটার সংক্রান্ত হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার সবকিছুই আমরা তাদের দিয়েছি। আরও বললেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কীকরণ পূর্বাভাস যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ। তার পরও এ ঝড়ে বাংলাদেশে এত প্রাণহানি হয় অথচ ইউরোপ-আমেরিকায় প্রাণহানির সংখ্যা নেই বললেই চলে। ওই বিশেষজ্ঞরা আমাকে এর বাস্তবতা উপলব্ধিতে অনেক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিলেন এবং সারা বিশ্বের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর অসংখ্য ছাপানো কাগজপত্রাদি পাঠালেন। বাস্তবতার অনেক দিক নিয়ে পর্যালোচনা করার এক পর্যায়ে আমাদের শিক্ষা ও ধর্ম প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার অকার্যকর দিকগুলো আবিষ্কার করলাম। এ পর্যায়ে আমি আমার এ বাস্তব গল্পের কথাগুলো শেষ করে পরে সুযোগমতো শিক্ষা ও ধর্ম প্রতিষ্ঠানের ওপর আলোকপাত করার ইচ্ছা পোষণ করি। মার্কিন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের দেওয়া জ্ঞানগুলো মাথায় রেখে দ্রুত একটি ইংরেজি প্রবন্ধ তদানীন্তন The Daily Observer পত্রিকার সম্পাদক সাহেবকে পাঠালাম ও দ্রুত প্রবন্ধটি ছাপানোর অনুরোধ জানালাম। সম্পাদক সাহেব আমার কথার প্রতি সম্মান করে ও এর জাতীয় গুরুত্বের কথা ভেবে প্রবন্ধটি পাওয়ামাত্র ছাপালেন।
প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘Cyclone Disaster and Some Relevant Thoughts’. বাস্তবতার নিরিখে এ প্রবন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয় এবং ভবিষ্যতে এ ঝড় মোকাবিলা ও প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে দ্রুত সমুদ্রসৈকতজুড়ে শক্তিশালী শেল্টার, সমুদ্রপ্রাচীর তৈরির প্রস্তাবসহ গণসংযোগের জন্য মাইকিং, আবহাওয়াসংক্রান্ত রেডিও, টেলিভিশনের বিশেষ চ্যানেল খোলার প্রস্তাব করা হয়। ১৯৯৫ সালে দেশে ফিরে আসার কিছু দিন পরই আমাকে চকোরিয়ার সেই স্থানে যেতে হয়। স্থানীয় লোকজন আমাকে জানাল, আমরা হাজার হাজার লাশের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কে জানে হয়তো তাদের আত্মা আমাকে ওখানে টেনে নিয়ে গেছে! চকোরিয়ার একটি নির্জন দ্বীপের একটি শেল্টারে রাত যাপন করতে হয়েছে।
এরপর বাংলাদেশের উপকূল ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দিয়ে ওরকম ভয়াবহ ঝড় আঘাত করলেও হতাহতের সংখ্যা কয়েকজনের বেশি হয়নি। আমার মতে, মহান প্রভু মানবতার এ মহান দায়িত্ব দিয়েই আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। জীবন-মৃত্যুর এ খেলার মধ্যে আমাদের কর্তব্য কীভাবে আমরা সম্পাদন করি, তা-ই মৃত্যুর পর আমাদের পরিচিতি নির্ধারণ করবে।
রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির আদর্শ কখনো স্থবির হয়ে থাকে না। মানবতার ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে সঙ্গে ওগুলোরও পরিবর্তন হয়ে চলেছে। কিন্তু মৌলিক নীতির পরিবর্তন হয় না কখনো। জালিমের জুলুমবাজি, শোষকদের শোষণনীতি, দুরন্ত ও দুর্ধর্ষজনের ভেদ-বৈষম্য নীতি, হিংসা-নিন্দা, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, অত্যাচার-অবিচার-এসব যেমন শাশ্বত পাশবিক নীতি, ঠিক তেমনি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সংগ্রামী কণ্ঠও চিরকাল সোচ্চার আছে। তারই নাম মানবতা ও কল্যাণবাদী আদর্শ। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন লাখ লাখ, হাজার হাজার নেতা।
ক্ষমতালোভী রাজনীতি সর্বজনীন নয়। নিঃস্বার্থ রাজনীতিই আমাদের একমাত্র কাম্য, যা দেশের প্রগতির পথকে ত্বরান্বিত করতে পারে। রাজনীতি তো অনেকেই করেন, ক্ষমতার আসনে অনেকেই অধিষ্ঠিত হন, কিন্তু ক্ষমতার আসনে বসে কজন তার নীতি-নিষ্ঠা বজায় রেখে চলতে পারেন? পরিপূর্ণ আদর্শবান হলে তবে তো হতে পারে আদর্শ রাজনীতি।
মহান স্রষ্টা সবারই জন্য খাদ্যের জোগাড় করে রেখেছেন। কিন্তু অনেকে জ্ঞানের অভাবে ও বুদ্ধি দোষে অভাবে পড়ে। উৎপাদন করার জ্ঞান দেওয়া হয়েছে মানুষকে। সে কি ঠিকভাবে তার চর্চা করে যাচ্ছে? মানুষ কি মনুষ্যত্বের মহান শিক্ষার পথে চলছে? প্রত্যেক মানুষকে তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা দুনিয়ার সব মানুষের কল্যাণ চিন্তা করতে হবে, উৎপাদনের কর্মে নিযুক্ত থাকতে হবে এবং তার সবকিছু দুনিয়ার সব মানুষের জন্য ত্যাগ করার মনোভাব গড়ে তোলার শিক্ষা দিতে হবে। অর্থনীতির মূল শিক্ষা যদি এই হয়, তাহলে অভাব থাকবে কীসের? ত্যাগের সুমহান শিক্ষা এবং ত্যাগীর উৎপাদনই সুশিক্ষা, আর ভোগের শিক্ষাই কুশিক্ষা।
মিফতাহুর রহমান : শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিজ্ঞান ও কারিগরি পরামর্শক
miftahur1710@gmail.com