দূষণের শীর্ষে ঢাকা প্রতিকার কী
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা আবারও প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। গত শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় ছিল ঢাকার নাম। এর আগে ২১ জানুয়ারিও দূষণের শীর্ষে ছিল ঢাকা। এরও আগে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এবং এ বছরে জানুয়ারির শুরু থেকে দূষণে একাধিকবার তালিকার শীর্ষে ছিল ঢাকা।
এ ধরনের খবর নিশ্চয়ই ঢাকা তথা দেশবাসীর জন্য মোটেই সুখকর নয়। বরং তা উদ্বেগের বিষয়। মধ্যযুগের বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনা তার গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে বলেছিলেন, মানুষের ভেতরে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে যদি ধূলিকণা না ঢুকত, তাহলে সে লাখ লাখ বছর বাঁচত। এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, সুস্থ জীবন নিয়ে মানুষের দীর্ঘায়ু লাভের ক্ষেত্রে ধূলিকণামুক্ত নির্মল ও বিশুদ্ধ বায়ু বা বাতাসের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আবার উলটোদিক থেকে বিষয়টি দেখলে, দূষিত বাতাস বা দূষিত পরিবেশ আয়ু কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা, ধূমপান ও ডায়াবেটিস-এ তিনটি কারণে যেসংখ্যক মানুষ মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। পরিবেশ ও চিকিৎসাবিদ্যা মতে, বায়ুদূষণ থেকে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) নামে শ্বাসতন্ত্রের যে রোগ হয়, তা বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। আর ২০১২ সালে শুধু এ রোগেই পৃথিবীতে যে পাঁচটি দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। কারণ, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ এ দেশের বড় শহরগুলোয় বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি।
বায়ুদূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাববিষয়ক চিত্রটি আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই ঘটছে পরিবেশদূষণ। বিশ্বের প্রভাবশালী স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশদূষণের কারণে ঘটা মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে। আর রাজধানী ঢাকা তো অনেক বছর ধরেই বসবাসের অযোগ্য ও নিকৃষ্টতম শহরগুলোর একটি, যার অন্যতম কারণ পরিবেশ দূষণ।
অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন, বাড়ি ও কলকারখানার দূষিত ও রাসায়নিক পদার্থ নির্গমন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, নাগরিক অসচেতনতা ইত্যাদি পরিবেশ দূষণের কারণ। ২০১৯ সালে WHO ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হলো বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। আর ২০১৮ সালে সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ছিল তৃতীয়। ঢাকার বায়ুদূষণের এ চিত্র সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে ঢাকার বায়ুমান মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর।
ঢাকা শহরের বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। WHO-এর তথ্যানুসারে, পিএম ২.৫ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সহজেই শরীরে প্রবেশ করে তা শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগসহ হৃদরোগের পরিমাণ বাড়ায় এবং পিএম ২.৫-এর কারণে অ্যাজমা ও ফুসফুসের ক্যানসারও হতে পারে। আর বায়ুদূষণের কারণে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়।
ঢাকার বাতাস দূষিত হওয়ার কারণ কী এবং তা রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানাতে ইতোপূর্বে মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে যেসব পরিবহণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, সেসব যানবাহন জব্দ করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে সুপারিশসংবলিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন হাইকোর্টে উপস্থাপনের পর আদালত ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে মোট ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) এক রিট আবেদনের ধারাবাহিকতায় বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশনা দেন। নির্মল বায়ু ও পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকায় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এ টাকা পরিবেশ অধিদপ্তর কীভাবে ব্যয় করেছে, পরিবেশ উন্নয়নে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছে, এতে জনগণ কী ধরনের সুফল পাচ্ছে অর্থাৎ পুরো প্রকল্পের টাকা কীভাবে ব্যয় হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দিতে সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্টের দেওয়া ৯ দফা নির্দেশনায় সড়ক পরিবহণ আইনের বিধান অনুযায়ী পরিবহণের ‘ইকোনমিক লাইফ’ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। যেসব পরিবহণের ইকোনমিক লাইফের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেসব পরিবহণের চলাচল নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া চলমান টায়ার পোড়ানো ও ব্যাটারি রিসাইকেলিং বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ আদেশ বাস্তবায়ন করে পরিবেশ অধিদপ্তরকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। পাশাপাশি ঢাকার পাশের চার জেলা গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে যেসব অবৈধ ইটভাটা এখনো বন্ধ করা হয়নি, সেগুলো বন্ধ করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় বালু, ময়লা, বর্জ্য বহনের সময় বহনকারী ট্রাকসহ সংশ্লিষ্ট যানবাহন যাতে ঢেকে চলাচল করে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
দোকান বা মার্কেটের ময়লা যাতে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে ফেলা হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ এলাকায় বালু, সিমেন্ট, মাটিসহ নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন ও নির্মাণকাজ যাতে আইন ও দরপত্রের শর্তানুযায়ী নিশ্চিত করা হয়, তারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের যেসব ধুলাবালিপ্রবণ এলাকায় এখনো পানি ছিটানো হয়নি, সেসব এলাকায় নিয়মিত পানি ছিটাতেও বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, হাইকোর্টের নির্দেশগুলো কতটা পালন করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর?
ঢাকার বাতাসের এ যখন অবস্থা, তখন বাতাসে ভাসমান মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মিহি ধূলিকণার মাত্রা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে রাজশাহী শহর বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বের শহরগুলোয় বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে রাজশাহীর এ দৃষ্টান্ত থেকে একটা বিষয় সবার কাছে অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রয়াস এবং সবার সহযোগিতা থাকলে অবশ্যই একটি শহরের শুধু বায়ুদূষণ কমানো নয়, ওই শহরকে সবচেয়ে ভালোভাবে বসবাস উপযোগী করে তোলাও সম্ভব। এমনকি সারা বিশ্বের মধ্যে ওই শহরকে সবচেয়ে সুখী শহরেও পরিণত করা সম্ভব।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাজশাহী শহর বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে যদি প্রথম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়, তাহলে কেন ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা কিংবা দেশের অন্যান্য শহরে বায়ুদূষণ কমানো যাচ্ছে না? নাকি ওই শহরগুলোয় বসবাসরত মানুষজন দূষণ পছন্দ করেন? আসলে বায়ু বা অন্যান্য দূষণ কমানোর জন্য কোনো জাদুর কাঠির প্রয়োজন নেই। ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টের নয় দফা নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কঠোর হতে হবে।
পাশাপাশি প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হয়ে পরিবেশ রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে হবে। এক কথায়, বাস্তবমুখী, জোরালো ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। আর তা সম্ভব হলেই ঢাকা শহরসহ সারা দেশের বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে এখন থেকেই পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, গণমাধ্যম, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ আমাদের সবাইকে তৎপর হতে হবে।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com