বন্ধুত্বের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে
পিডিশন প্রধান
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবস। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করেছে অস্ট্রেলিয়া।
দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত বিশাল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এ দেশের সঙ্গে একত্রে পথচলার ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা চলমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থনদানকারী এবং প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশগুলোর অন্যতম অস্ট্রেলিয়া। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী আমাদের বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক উইলিয়াম ওভারল্যান্ড।
তিনি সেসময় ঢাকায় বাটা শু কোম্পানিতে কর্মরত থাকাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে রাজধানী ঢাকার একটি সড়কের নামকরণও করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক দশকগুলোয় অস্ট্রেলিয়া এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিকট ও দূর প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় ও স্থায়ী করার বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রতিফলন দেখা যায় দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, প্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরালোভাবে এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপের মাধ্যমে। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে বহুমাত্রিক সম্পর্কের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে অস্ট্রেলিয়া অন্তত ৬০টি দেশে ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও অনুদান দিয়ে যাচ্ছে। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, অস্ট্রেলিয়ার সরকার পিপল টু পিপল যোগাযোগকে উভয় দেশের কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচনা করে। সার্কের পর্যবেক্ষক ও বিমসটেকে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী হিসাবে অস্ট্রেলিয়া এ অঞ্চলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পর্যটন খাতের উন্নয়নে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে।
বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশাল এ দেশের পরিশ্রমী, আন্তরিক, বন্ধুবৎসল ও হাস্যরসবোধসম্পন্ন মানুষের উদার মানসিকতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতা অভিবাসী, ভ্রমণকারী বা সেদেশে বসবাসকারীদের যে সুন্দর ও স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা দেয়, তা সহজে ভোলার নয়। আরেকটি উল্লেখ করার মতো তথ্য হলো, নাগরিক সুবিধা ও জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় পৃথিবীর প্রথম ১০টি বাসযোগ্য শহরের মধ্যে অন্তত অর্ধেকসংখ্যক শহরের অবস্থান অস্ট্রেলিয়ায়।
আমরা জানি, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জাতিসত্তাগুলোর প্রতি অতীতে অনেক অবিচার করা হয়েছে; অনেক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত অতীতের সরকারগুলোর গৃহীত নীতির বিষয়ে তদন্ত ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টে সর্বসম্মতক্রমে আদিবাসী ও এবোরিজিনালদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব পাশ হয় ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। অস্ট্রেলিয়া সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আদিবাসীদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেভিন রড। সে কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ২৬ মে ‘ন্যাশনাল সরি ডে’ হিসাবে পালন করা হয়ে থাকে। বিশ্বের ইতিহাসে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি একটি বিরল ঘটনা। জাতি গঠনে এটি রাজনৈতিক ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নকারীদের উদার ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানসিকতার প্রতিফলন। শুধু দিবস পালন নয়, কার্যক্ষেত্রেও রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে প্রতিটি সরকারের শাসনামলে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়াও পর্যায়ক্রমে তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যগত বন ও ভূমি আদিবাসী ও এবোরিজিনালদের কাছে ফেরত দেওয়া হচ্ছে।
সত্তর বছরেরও অধিককাল ধরে অস্ট্রেলিয়া সরকার বাংলাদেশ ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেক্টরে বিকাশমান, উদীয়মান, নেতৃস্থানীয়, মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল ব্যক্তিদের শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে থাকে। এ বৃত্তির লক্ষ্য হলো, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিজ নিজ ক্ষেত্রের বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ শেষে দেশে ফিরে এসে শিক্ষার্থীরা যেন নিজ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষালাভ করা জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান ও মেধাবী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনসহ সমাজ ও দেশের বহু ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ছাড়াও অর্ধলক্ষাধিক বাংলাদেশি পেশাদারি উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মী অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ১১ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ২২ হাজারেরও বেশি বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। উচ্চশিক্ষার মান তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়া সরকারের রয়েছে ‘টারসিয়ারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড এজেন্সি’। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান ও অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ও সঠিক তথ্য প্রদান এবং সহযোগিতা করার জন্য রয়েছে বিশেষ বিধান ও আইন।
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ালেও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন বাংলাদেশি পণ্যের অস্ট্রেলিয়ায় শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল পণ্য ছাড়াও পাট ও চামড়াজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার, মাছ আমদানি করে থাকে। কৃষিজাত পণ্য ও খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভারী শিল্পের কাঁচামালের অন্যতম উৎস খনিজসম্পদসমৃদ্ধ দেশ অস্ট্রেলিয়া। বিগত দশকে দুদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২ বিলিয়ন ডলারের অধিক হওয়ার ফলে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে, যদিও এখনো বাণিজ্যের আরও ক্ষেত্র ও সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ লক্ষ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উভয় দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ে বৈঠকসহ বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রসহ বহু মৌলিক আবিষ্কারে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ব্যবিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকরা। এর স্বীকৃতি এসেছে নোবেলসহ বহু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে এককভাবে শুধু অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও গবেষকরা তাদের মৌলিক আবিষ্কারের জন্য এ পর্যন্ত সাতবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেসমেকার, ব্ল্যাকবক্স ফ্লাইট রেকর্ডার, আল্ট্রা সাউন্ড থেকে শুরু করে হালের তথ্যপ্রযুক্তি জগতের ওয়াইফাই, গুগল ম্যাপস ইত্যাদি অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ অস্ট্রেলিয়ার জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশ্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ বায়ুর অধিকারী অঞ্চল এবং ইউনেস্কোর বহু ঐতিহ্য নিদর্শনের এবং পৃথিবীর বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর ‘গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে’র পাশাপাশি সবচেয়ে বৃহৎ মনোলিথ রয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। পৃথিবীতে এমন অনেক বিরল জীব ও প্রাণী রয়েছে, যার আবাসস্থল শুধুই অস্ট্রেলিয়া।
আমাদের প্রত্যাশা, অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি মানবিক সহায়তা, ভবিষ্যতের জন্য সুস্থ, নির্মল ও বাসযোগ্য পরিবেশ গঠন ও তা রক্ষার স্বার্থে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত আরও প্রসারিত করবে। বাংলাদেশের অকৃত্রিম ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসাবে অস্ট্রেলিয়া নিরবছিন্নভাবে তার বন্ধুত্বের স্বাক্ষর রেখে চলবে।
পিডিশন প্রধান : অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ছাত্র সংসদের সাবেক সভাপতি