Logo
Logo
×

বাতায়ন

চেতনায় বুদ্বুদ

হাতকড়া আর ডান্ডাবেড়ি করিস যদি তেড়িবেড়ি!

Icon

বদিউর রহমান

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাতকড়া আর ডান্ডাবেড়ি করিস যদি তেড়িবেড়ি!

এখন আমার মাও নেই, বাবাও নেই-আমার যে কী আনন্দ লাগছে। অনেক সময় মা-বাবা না থাকা বেশ আনন্দের হয়। কারণ এখন অনেক ছেলেমেয়ে মা-বাবাকে আগের মতো সম্মান তো করেই না, বরং অসম্মানের চরমেও নিয়ে যায়। পত্রপত্রিকার খবরে এ ধরনের অসম্মানের কত খবর যে পড়ি, তার তালিকা বড়ই হবে। একবার পড়লাম, বাবা নিজের জায়গা-জমি ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দিয়েছেন। পরে এক ছেলের কাছে কিছু ধান চান। ছেলেটি রেগে গিয়ে এক আঘাতেই বাপকে মেরে ফেলল। আমার বেগমকে খবরটা পড়ে শোনালাম, চোখের পানি পড়ল; বললাম, আমার কী হবে? মা-বাবাকে কোনো কোনো সন্তানের রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসার খবর তো আছেই। নিজেদের বড় বড় ঘর থাকলেও মা-বাবার জন্য জায়গা হয় না, কেউ হয়তো গরুর ঘরে রেখে আসে, কেউবা রাস্তায় ছেড়ে দেয়। বৃদ্ধাশ্রমের কত কাহিনি পড়লাম আর আবেগে অশ্রুপাত করলাম। বাবা-ছেলে একসঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে একসময়ে-সেই কালজয়ী গানও অনেককে ভাবায় না। বড় বড় উচ্চশিক্ষিত মানুষের সন্তানদের কারও কারও মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার খবর বড় কষ্ট দেয়। প্রায়ই চোখ বুজে নিজের ভাবী পরিণতি নিয়ে ভাবি। তাই বলি, আমার মা-বাবা নেই বলে আমি অন্তত তাদের সঙ্গে তেমন কোনো ব্যবহার করার সুযোগ পাব না-এতেই আমার রক্ষা। তারা নেই বলে আমার আনন্দ, আমি বেঁচে গেলাম।

মনে পড়ে গেল, মা মারা গেলেন ১৯৭১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭০-এর নির্বাচন নিয়ে প্রায় প্রতিদিন আমরা আওয়ামী লীগের মিছিলে যেতাম। চাচা ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটির মেম্বার। তিনি আমাদের বড় বড় পোস্টার বাঁশের চাটাইয়ে আঠা দিয়ে খুঁটিসহকারে প্রস্তুত করে দিতেন। আমরা স্লোগান লিখে দিতাম। সে সময়ের বিখ্যাত বিখ্যাত স্লোগান-তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা; পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা; তোমার-আমার মার্কা কী? নৌকা-নৌকা; জয় বাংলা-জয় বাংলা-ইত্যাদি তো ছিলই। সঙ্গে আমরা তখনও যোগ করেছিলাম-দলে দলে যাও কোথায়?-আওয়ামী লীগের জনসভায়। প্রায়ই ঘরে ফিরতে দেরি হতো। আমরা ডোমুরুয়া (এখন নাম ডুমুরিয়া) গ্রাম থেকে বেরিয়ে রাজাপুর বাজার হয়ে কাসিমপুর ঘুরে লক্ষ্মীয়ারা বাজার দিয়ে এলাহীগঞ্জ বাজার হয়ে বাড়ি ফিরতাম-প্রায় ৯-১০ মাইল হয়ে যেত। মা চেরাগ জ্বালিয়ে আমার খাবার নিয়ে বসেই থাকতেন। মা আমাকে জয় বাংলা সাহেব ডাকতেন। সেই মা আমার মরে গেল আমার হাতে মাথা রেখে। আমরা তিন ভাইবোন পালাক্রমে মায়ের ডিউটি করছিলাম। মৃত্যুর ৩-৪ দিন আগে আমাদের ফেনীর নামকরা ডাক্তার-কাসেম ডাক্তারের (মরহুম জিয়াউদ্দীন বাবলুর আব্বা) কাছ থেকে মায়ের ব্যবস্থাপত্র এনেছিলাম। তিনি বলে দিলেন, অবস্থা খুবই খারাপ, যদি সপ্তাহখানেক টিকে যায় তবে ঢাকা বা চট্টগ্রাম নিতে পারো। তা আর হলো না। বড় ভাই চট্টগ্রাম গেলেন আব্বাকে আনার জন্য। আমি মাইল ছয়েক হেঁটে ফেনী গেলাম একজন ফটোগ্রাফার আনতে। মা আমার কবরে চলে যাবেন, আমার তো তার একটা ছবি অন্তত রাখতে হবে। ফেনীর সুরত মহলের পাশের এক ফটোক্লাব স্টুডিও থেকে আপ-ডাউন রিজার্ভ রিকশা নিয়ে (ভাড়া ৫ টাকা মোট) আর ফটোগ্রাফারের জন্য ৫ টাকা চুক্তিতে তাকে বাড়ি এনে মায়ের একটা ছবি তোলা হলো। সে ছবিটিই আমার সম্বল এখন। এবার আমি টের পেলাম, আমার কাছে আমার মা যেমন বড় আপন, আরও অনেকের কাছেও নিজ নিজ মা তেমনই আপন। তেমন একজনই গাজীপুরের কালিয়াকৈরের পাবরিয়াচালা এলাকার আলী আজম।

আলী আজম কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। নিজের মায়ের জানাজা তিনি নিজে পড়িয়েছেন। তিনি মামলার আসামি, গত ২১ ডিসেম্বরের প্রথম আলোর ভাষ্যমতে ‘গায়েবি’ মামলার আসামি। প্যারোলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, জানাজার সময়ও তার হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়া হয়নি। আগে আমি ছয়টি দৈনিক পত্রিকা রাখতাম, আর্থিক কারণে এখন তিনটা রাখি। ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর যুগান্তরে ৮ কলামের এক কলামে ছোট্ট একটা ছবিসহ ‘হাতকড়া ডান্ডাবেড়ি নিয়েই মায়ের জানাজা পড়ালেন বিএনপি নেতা’ শীর্ষক খবরটি পড়লাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনে ওই তারিখে এ খবরটি আমার চোখে পড়ল না। তবে উপসম্পাদকীয়তে সাবেক স্বাস্থ্য সচিব হোসেন আবদুল মান্নানের ‘অমানবিক আমলাতন্ত্র ও আমার দুঃখবোধ’ শীর্ষক একটা করুণ অভিজ্ঞতার বিবরণ পেলাম। একজন বড় আমলা নিজের ঘটনা দিয়ে আমলাতন্ত্রকে অমানবিক যে বলেছেন, এটার জন্য তিনি সাধুবাদ পেতে পারেন। কিন্তু নিজের বেলায় যা ঘটেছে, তাতে যদি আমলাতন্ত্র অমানবিক হয় তাহলে এক সাংবাদিককে যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অযথা হেনস্তা করা হলো, সেটা কি অমানবিক ছিল না? নথির কাগজপত্রের গোপনীয়তা বা নথি হেফাজতে মন্ত্রণালয়ের আমলারা ব্যর্থ হলে, সচিবের একান্ত সচিবও ব্যর্থ হলে তখন সাংবাদিক যদি কোনো তথ্য নিয়েই নেন, তাহলে তাকে কেন দোষ দেওয়া হবে? সাংবাদিকদের কাজই তো হলো তথ্য বের করা। আর ওটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নের তথ্যও ছিল না। আবদুল মান্নান আমার ‘সরকারি চাকুরিতে আমার অনুভূতি-পদোন্নতি বঞ্চনা’ বইটি পড়ে নিলে (এখন ‘সরকারি চাকুরিতে আমার অনুভূতিসমগ্র’ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত) আরেকটু বুঝতে পারবেন আমাদের আমলারা কত অমানবিক হতে পারেন। মান্নানকে সমবেদনা জানানো ছাড়া এখন আর আমি কী-ই বা করতে পারি।

গত ২১ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় আট কলামের হিসাবে চার কলামের বিরাট ছবির উপরে “হাতে ‘হাতকড়া’ ও পায়ে ‘ডান্ডাবেড়ি’ পরে মায়ের জানাজায়” দেখে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হলো। নিচে ‘গায়েবি’ মামলার আসামি বিএনপির নেতা হাতকড়া পরে মায়ের জানাজায়’-গাজীপুর প্রতিনিধির খবর তো আছেই। ভাগ্যিস আমার মা-বাবা নেই। ‘জানাজার সময় হাতকড়া খুলে দিলে ভালো হতো : তথ্যমন্ত্রী’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ ডিসেম্বর) এবং ‘মানবাধিকার কমিশন-ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে জানাজায় নেওয়া অমানবিক’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩ ডিসেম্বর) খবর দুটি আমাকে আরও অবাক করল। বক্তব্যগুলো যেন কেমন দায়সারা গোছের! কেউই যেন এখন আর পুলিশের এহেন কাণ্ড নিয়ে তেমন ‘রা’ করতে আগ্রহী নয়। বাংলাভাইয়ের কাণ্ড-পা উপরে মাথা নিচে গাছে ঝোলানো লাশ দেখার পর এ আর এমন কী অমানবিক!

আমরা বেশ আগে থেকেই লক্ষ করে আসছি, পুলিশের অদক্ষতা যেমন বেড়েছে, তেমনই নিষ্ঠুরতাও বেড়েছে। ‘ক্রসফায়ারের’, ‘বন্দুকযুদ্ধের’ সময়ে আমরা খবরে দেখতাম, আসামিকে নিয়ে অন্য আসামি ধরতে গেলে পুলিশের হেফাজতের (এমনকি র‌্যাবের হেফাজতেরও) আসামির লোকজন তাদের ওপর আক্রমণ চালালে পুলিশ/র‌্যাব পালটা গুলি করে। তখন আসামি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আসামি তখন হয়তো ক্রসফায়ারে(?) পড়ে যায়। আজরাইল তখন সুযোগটা হাতছাড়া করেন না। ওসব খবরে আমি হতবাক হতাম এই ভেবে যে, আমাদের পুলিশ বা ক্ষেত্রমতো র‌্যাব নিশ্চয় আসামিকে তখন মুক্ত অবস্থায় নেয় না, আসামির হাতে হাতকড়া বা পায়ে ডান্ডাবেড়ি অথবা দুটিই থাকে। তাহলে তাদের হেফাজতে থাকা আসামিটা মারা যায় কীভাবে? তার হেফাজত তো আগেই বিবেচ্য। যে পুলিশ বা র‌্যাব তাদের হেফাজতে থাকা আসামিকেই হেফাজত করতে পারে না, তারা রাষ্ট্রের হেফাজত করবে কীভাবে? নিকট অতীতে জঙ্গির পলায়ন, তাও নাকি ফাঁসির আসামি, আমাদের কী বার্তা দিল? আদালতে নেওয়ার পথে কিংবা আদালত প্রাঙ্গণ থেকে জঙ্গির পলায়ন নিশ্চয়ই আমাদের পুলিশকে একটা বড় শিক্ষা দিয়েছে, আর তাই জানাজার সময়ে আলী আজমের হাতকড়া বা ডান্ডাবেড়ি খুলে দিয়ে তাকে পালানোর সুযোগ করে দিয়ে নতুন ঝামেলায় যেতে চায়নি পুলিশ। উত্তম, পুলিশ এত সতর্ক থাকলে ভবিষ্যতে আর কোনো আসামি ভাগতে পারবে না। তবে জঙ্গি পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টাকে অর্থাৎ হাতকড়া বা ডান্ডাবেড়ি ছাড়া তাদের আদালতে নেওয়াকে অনেকে সহজভাবে নিচ্ছে না। কেউ কেউ এটা নিয়ে ভিন্নকথা বলছে। এদের যদি আটক করা যায়, তারপর যদি পলায়নের কিস্সা-কাহিনির প্রকাশ ঘটে আর কী! এখনো কেউ এটাকে যে হিন্দি সিনেমার শুটিংয়ের অংশ বলেনি-তাতেই আমরা সন্তুষ্ট।

কিন্তু এ পুলিশদের গুলিতে যখন কোনো মিছিলের লোক মারা যায়, তখন আমরা আরও বিস্মিত হই। আমরা অবাক হই এজন্য যে, আমরা বোকা। মিছিলকারীরা পুলিশকে আক্রমণ করলে পুলিশ তো আত্মরক্ষার্থে গুলি করতেই পারে। পুলিশ যে আইনের লোক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা পুলিশের ফরজ কাজ। বিরোধী দলের মিছিল হলে তো ফরজটা আরও বড় হয়ে পড়ে। কিন্তু চাকরিপ্রত্যাশীদের পুলিশ লাঠিপেটা করে কেন? ‘স্কুলে নিবন্ধিতদের চাকরি দাবি-শাহবাগে অনশন, অবরোধ, পুলিশের লাঠিপেটা’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২২ ডিসেম্বর) খবরের পাশের ছবিটা কী চমৎকার না! রাষ্ট্রটা কি পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে নাকি? সরকারের অবশ্যই পুলিশি অ্যাকশন অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়, নয়াপল্টনে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঠেকাতে পুলিশি অ্যাকশন ছাড়া সরকারের গতি ছিল না, যেমন ২০১৩ সালে মতিঝিল থেকে হেফাজতিদের সরাতে। পুলিশ হচ্ছে গিয়ে রাষ্ট্রের লাইসেন্সধারী লাঠিয়াল; তারা মারলে, পেটালে, এমনকি গুলি করে মেরে ফেললেও তা সরকারি ভাষায় হবে জনস্বার্থে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে। এই ভয়ে আমি এখন কোনো সভায়ই যাই না, যে কদিন পারি বেঁচে থাকি না অন্তত। কিন্তু অনেক অবরোধে যে পুলিশ মারে না, বরং সহযোগিতা করে, সেটার রহস্যও তো বুঝি না।

শেষ করি একটা বাস্তব গল্প দিয়ে। জনাব মোহাম্মদ আলী (সাবেক স্বাস্থ্য সচিব) তখন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক। বিরোধী দলের মিছিল হবে একটা। পুলিশের মহাপ্রস্তুতি, যেভাবেই হোক মিছিল ঠেকাতে হবে, ছত্রভঙ্গ করতে হবে, প্রয়োজনে পেটাতে হবে-ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসপি সাহেব জেলা প্রশাসককে চমৎকার কর্মপরিকল্পনা জানালেন। মোহাম্মদ আলী সাহেব শুনলেন; বললেন, অতসব কিছুর প্রয়োজন নেই, মিছিল হতে দেবেন; শুধু বলে দেবেন এবং দেখবেন অন্যথা যেন না করে। মিছিল শেষে তাদের আমার কক্ষে চায়ের দাওয়াত দিয়ে রাখবেন। বিরোধী দল মিছিল করার কৃতিত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। এ ধরনের মিছিলে সরকারের কোনোই ক্ষতি হবে না। মিছিল হয়ে গেল, তারা খুশি। কিছু বুঝলেন?

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম