আশেপাশে চারপাশে
নিষেধাজ্ঞা কেন কার্যকর হলো না
চপল বাশার
প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত শনিবার রাতে ঢাকা মহানগরীতে যা ঘটেছে, তাকে কীভাবে বর্ণনা করা যায়? উচ্ছৃঙ্খলতা না অসভ্যতা? নাকি আনন্দ-উল্লাসের নামে একশ্রেণির তরুণ-যুবকের মানসিক বিকৃতি? থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনের জন্য মধ্যরাত থেকে একটানা পটকা ফোটানো ও বোমাবাজি হয়েছে সারা শহরে। একই সঙ্গে চলেছে বেপরোয়া আতশবাজি পোড়ানো আর ফানুস ওড়ানো। সে রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য পরিবেশটা এমনই হয়েছিল যে, মনে হয়নি এটি কোনো সভ্য রাষ্ট্রের রাজধানী শহর। কতিপয় তরুণের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে রাতে নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়।
থার্টিফার্স্ট নাইটে ফানুস ওড়ানো, আতশবাজি ও পটকা ফোটানো, বোমা ফোটানো নিষিদ্ধ করেছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। বিশেষ করে ফানুস ওড়ানোর বিষয়ে। কারণ, ফানুস ও আতশবাজি থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। কিন্তু কোনো নিষেধাজ্ঞা কেউ মানেনি। এর কারণ হতে পারে, এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল থার্টিফার্স্টের পূর্বক্ষণে, যা আরও আগে দেওয়া এবং ঘন ঘন প্রচার করা উচিত ছিল। দ্বিতীয়ত, পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকাই পটকা, আতশবাজি ও ফানুস বিক্রির প্রধান কেন্দ্র। সেখানকার দোকানগুলো থেকে অবাধে এসব বিস্ফোরক দ্রব্য বিক্রি হয়েছে গত কয়েকদিন। পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি। ডিএমপির দেওয়া নিষেধাজ্ঞা পুলিশই কার্যকর করেনি। অতএব বিক্রেতারা অবাধে পটকা, বোমা, আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি করেছে। ক্রেতারাও আনন্দের সঙ্গে কিনেছে, মহানন্দে সেগুলো ফুটিয়েছে, পুড়িয়েছে সারা শহরে।
ফানুস ওড়ানো একটি আনন্দের খেলা, কিন্তু সেটি সঠিকভাবে ও সাবধানে করতে হয়। অন্যথায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে সেই রাতে দুই শতাধিক ফানুস ওড়ানো হয়। ভাগ্য ভালো, এসব ফানুস কোনো অগ্নিকাণ্ড ঘটায়নি। পুলিশ ও কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করলে সহজেই এসব ফানুস ওড়ানো বন্ধ করতে পারত। শুধু ফানুস কেন, পটকা-বোমা ফোটানো, আতশবাজি পোড়ানোও বন্ধ করা যেত, যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সময়মতো অ্যাকশন নিত। ঢাকা শহরের প্রতিটি থানা যদি সক্রিয় থাকত এবং সন্ধ্যা থেকেই সারা শহরে টহল দিত, তাহলে পটকা-বোমা ফোটানো বন্ধ হতো নিঃসন্দেহে।
পুলিশ ইচ্ছা করলে সবই পারে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, এক সময়ে শবেবরাতের রাতে ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে পটকা ফোটানো হতো, সেই সঙ্গে চলত নানা রঙের আতশবাজি পোড়ানো। নগরবাসী বিরক্ত হতেন, ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিত না। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে শেষরাত পর্যন্ত পটকা ফোটানো, বাজি পোড়ানো চলত। একসময় সরকারের উচ্চতর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নেয়। বিক্রেতারা শবেবরাতের সময় পটকা-আতশবাজি বিক্রি বন্ধ করে। এগুলোর ব্যবহারও সে সময় বন্ধ হয়। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল, শবেবরাতের সময় আর পটকা-বাজির শব্দ শোনা যায় না। শবেবরাতের সময় বন্ধ করা গেলে থার্টিফার্স্ট নাইটে বন্ধ করা যাবে না কেন? পুলিশ কর্তৃপক্ষ বোধহয় আরও উচ্চ কর্তৃপক্ষের হুকুমের অপেক্ষায় আছে।
শুধু থার্টিফার্স্ট নাইট কেন, বছরের অন্য সময়েও পটকা-বোমা-আতশবাজির উপদ্রব চলে। শীত ও বসন্তকাল বিয়ের মৌসুম। সে সময় দেখা যায়, বরযাত্রীরা পটকা ফুটিয়ে, বাজি পুড়িয়ে আনন্দ করতে করতে বিয়ের মণ্ডপে যাচ্ছেন। ঢাকা শহরে, বিশেষ করে পুরান ঢাকায় এটি একটি সাধারণ দৃশ্য। পটকা-আতশবাজি বিস্ফোরক পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়। এগুলোর ব্যবহার থেকে মারাÍক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তদুপরি পটকা ফোটালে যে শব্দ হয়, তা ক্ষতিকর শব্দদূষণের সৃষ্টি করে। ঢাকা শহরের বাসিন্দারা বিভিন্ন শব্দদূষণে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত। যানবাহনের শব্দ, মোটরগাড়ির হর্নের শব্দ, বিভিন্ন নির্মাণকাজ থেকে সৃষ্ট অব্যাহত শব্দদূষণ মানুষের শ্রবণশক্তির ক্ষতি করছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ঢাকাবাসীর শ্রবণশক্তি ক্রমেই কমে আসছে। পটকা-আতশবাজি শব্দদূষণ বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিস্ফোরক নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর আইন রয়েছে। সেই আইন প্রয়োগ করে পটকা-বোমা-আতশবাজির মতো ক্ষতিকর সামগ্রীর উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করে সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব। সরকার কেন তা করছে না, তা বোধগম্য নয়।
ফানুসের বেপরোয়া ব্যবহারে সদ্য চালু হওয়া মেট্রোরেল চলাচল রোববার সকালে দুই ঘণ্টা বন্ধ ছিল। আগের রাতে ওড়ানো বেশ কয়েকটি ফানুস উত্তরায় মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ লাইন ও খুঁটিতে আটকে থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আটকে থাকা ফানুসগুলো সরিয়ে নিয়ে মেট্রোরেল চালু করতে দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। মেট্রোরেল চালকরা সময়মতো এটি লক্ষ না করলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। কাজেই ফানুস ওড়ানোর মতো বিপজ্জনক খেলা বন্ধ করাও জরুরি।
থার্টিফার্স্ট নাইটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা শহরের সবকটি হোটেল, ক্লাব ও বারে মদ বিক্রি বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। এর কারণ আর কিছুই নয়, সেখান থেকে মদ বাইরে যায়, উচ্ছৃঙ্খল তরুণ-যুবকরা তা খেয়ে রাস্তায় মাতলামি করে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একই কারণে গুলশান, বনানী, বারিধারা কূটনীতিকপাড়ার রাস্তায় জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ও যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। কারণ, অতীতে দেখা গেছে, থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনের জন্য উচ্ছৃঙ্খল তরুণ-যুবকরা ওইসব এলাকায় গিয়ে রাস্তা বন্ধ করে আনন্দ-ফুর্তি করে, শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ায় কূটনীতিকপাড়ার বিদেশি বাসিন্দারা এবার শান্তিতে ছিলেন। তারা নিউ ইয়ার উদযাপন করলেও সেটি করেছেন ঘরের ভেতরে।
কূটনীতিকপাড়ায় কড়াকড়ি ব্যবস্থা নিয়ে যদি শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা যায়, শহরের অন্যান্য এলাকায় তা করা যাবে না কেন? সরকারের উচ্চতর কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ সহজেই এটি করতে পারে। এটি কেবল সদিচ্ছা ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়। আশা করা যায়, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চৈতন্য উদয় হবে, শান্তিকামী নগরবাসী শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন।
আরেকটি কথা। খ্রিষ্টীয় নববর্ষ ও থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। এটি পাশ্চাত্যের তথা বিদেশের সংস্কৃতি। বিদেশি সংস্কৃতি আমরা লালনপালন করব কেন এবং করতে দেব কেন? আমাদের মাটির সংস্কৃতি তথা বাঙালির সংস্কৃতি আমরা উদযাপন করব এবং সমুন্নত রাখব। অন্যথায় আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব সংকটের কবলে পড়বে।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com