
প্রিন্ট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:০৯ পিএম
অবহেলিত মুসলিমদের মুক্তি মিলবে কবে

চম্পা আক্তার
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67f593276b51f.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
মুসলিম জনসংখ্যা বলতে বিশ্বে ইসলামের অনুসারী লোকদের সংখ্যা বোঝায়। ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বে জনসংখ্যা প্রায় ৮০৯ কোটি, যার মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ২০৪ কোটি, যা বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ। মুসলিম উম্মাহ এক সময় ছিল জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, ন্যায়বিচারের আদর্শ এবং সভ্যতার প্রতীক। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এ গৌরবময় জাতি আজ বিশ্ব দরবারে অবহেলিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিন থেকে রাখাইন, ইয়েমেন থেকে সিরিয়া, উইঘুর থেকে কাশ্মীর-সবখানেই যেন এক অভিন্ন চিত্র। প্রশ্ন জাগে : মুসলিম জাতির প্রতি এই অবহেলা কবে শেষ হবে? মুক্তির পথ কোথায়?
ফিলিস্তিন আজ যেন এক রক্তাক্ত ভূমি। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী দখলদারিত্ব, সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার যদি কোনো রাষ্ট্র হয়ে থাকে, তবে তা ফিলিস্তিন, সেখানকার মুসলিম জনগণ। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিরা বসবাস করছে দখল, বোমা আর নিপীড়নের ছায়ায়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ও ভূমি দখল। ১৯৬৭ সালে গাজা ও পশ্চিম তীর দখলের মাধ্যমে তাদের আরও সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়। ইসরাইল বর্তমানে গাজায় অবরোধ আরোপ করে রেখেছে, যা সেখানে এক ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় সব ক্ষেত্রে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরাইল যখন নরহত্যা চালাচ্ছে, তখন বিশ্ব শক্তিগুলো রয়েছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। জাতিসংঘের একের পর এক প্রস্তাব শুধু প্রস্তাবেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের মধ্যে ঐক্যের অভাব এবং ওআইসির দুর্বল ভূমিকা ফিলিস্তিনিদের আরও দুর্বল করে রেখেছে।
ফিলিস্তিনিরা অবহেলিত কারণ তারা শক্তিহীন, বিভক্ত এবং বিশ্বরাজনীতির স্বার্থের বলি। রোহিঙ্গারাও জাতিহীন জীবনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার ‘নাগরিকত্ব আইন’ পাস করে, যাতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের স্বীকৃত জাতি হিসাবে স্বীকার করা হয়নি। এর ফলে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চলাফেরা, চাকরি, এমনকি বিয়ের ক্ষেত্রেও সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা চালিয়ে আসছে। ২০১৭ সালে চালানো ‘অপারেশন ক্লিয়ারেন্সে’ হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা, ধর্ষণ ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গণহত্যা ও আগুনের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখো লাখো রোহিঙ্গা আজও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বিশ্বের বড় শক্তিগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেশিরভাগ সময় নীরব থেকেছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু সীমিত সম্পদ ও স্থায়ী সমাধানের অনুপস্থিতিতে তাদের জীবন এখানে অস্থির ও নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে থাকা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইয়েমেন ও সিরিয়া অন্যতম। আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলায় দুই শক্তির সংঘাতে ধ্বংস হয়েছে দুটি মুসলিম ভূখণ্ড। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ, অনিরাপত্তা, বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক নীরবতা এ দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষকে করে তুলেছে অবহেলিত ও নিঃস্ব। ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধটি আজও অব্যাহত। হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে চলা এ সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। লাখ লাখ মানুষ অনাহার, চিকিৎসার অভাব এবং বাসস্থানহীনতায় ভুগছে। জাতিসংঘ একে ‘বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট’ বললেও আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও বিশ্বশক্তিগুলোর আগ্রহ আশানুরূপ নয়। সৌদি আরব ও ইরান এ সংকটকে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যবহার করেছে। আর সাধারণ ইয়েমেনি মানুষ হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বলি।
সিরিয়াতেও ২০১১ সালের আরব বসন্তের ঢেউ তথা সরকারবিরোধী আন্দোলন পরবর্তী সময়ে রূপ নেয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে। বাশার আল আসাদের সরকার, বিদ্রোহী গোষ্ঠী, কুর্দি মিলিশিয়া এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সংঘাতে দেশটি একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আজ সিরিয়ায় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ শরণার্থী, দেশের ভেতরে আরও কয়েক কোটি মানুষ মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনপ্রাপ্ত সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মতবিরোধপূর্ণ ভূমিকায় সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে কার্যকর সমঝোতা নেই। চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল শিনজিয়াংয়ে বসবাসকারী মুসলিম উইঘুর জাতিগোষ্ঠী আজ এক ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার। চীনা সরকারের কড়া নজরদারি, ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, গণ-আটক এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়নের শিকার হয়ে তারা হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম অবহেলিত মুসলিম জনগোষ্ঠী। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির ২০ কোটির বেশি মুসলিম জনগোষ্ঠী ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও নিপীড়নের মুখোমুখি হচ্ছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মারধর, এমনকি হত্যা পর্যন্ত ঘটে, যার অধিকাংশ ঘটনার বিচার হয় না। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও মিডিয়ার একাংশ মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যম যদিও ভারতের মুসলিম নিপীড়ন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণে বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
বিশ্ব রাজনীতি আজ স্বার্থনির্ভর। মানবতা ও ন্যায়বিচারের জায়গায় রয়েছে কূটনৈতিক হিসাব। এমন অবস্থায় মুসলিম বিশ্বের উচিত প্রকৃত সত্য বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়’। তাই মুসলিম উম্মাহকে জাগতে হবে, ভাবতে হবে, একত্র হতে হবে। তবেই মুক্তি আসবে। নইলে এ দীর্ঘ রাত হয়তো আরও দীর্ঘ হবে।
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়