
প্রিন্ট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১৩ এএম
নারীর প্রতি সহিংসতা ও আমাদের লজ্জা

আজাদ খান
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
আরও পড়ুন
গত কদিন হলো একটা ছবি আমার হৃদয়-মনকে বড় কাঁটা দিচ্ছে। একজন নারী উত্ত্যক্তকারীকে দাড়ি, টুপিওয়ালা কিছু তরুণ মাথায় পাগড়ি এবং ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নিচ্ছে এবং উল্লাস করছে। ভাবতে কষ্ট ও লজ্জা হয় সভ্যতাবিবর্জিত এ ঘটনা এবং এ ছবি আমার এ দেশের। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে যে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ৩০ লাখ শহিদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। আর মাত্র কদিন আগে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে যে দেশ আরেকবার অপশাসন, দুঃশাসনমুক্ত হয়েছিল। এমনসব বীরত্বগাথা যে জাতির, যে দেশের রয়েছে; সে দেশে এমন একটি ঘটনা কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু এসব ন্যক্কারজনক ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে, কেন ঘটাচ্ছে, দেখা যাক সেদিকে।
আজকাল রাস্তা-ঘাটে প্রায়ই নারীর পোশাক নিয়ে নারীর প্রতি অশালীন মন্তব্য, হেনস্তা কিংবা সহিংসতার ঘটনা ঘটছে এবং তা ক্রমেই বাড়ছে। কারা করছে? করছে এলাকার তথাকথিত মুরব্বি কিংবা তথাকথিত ‘ধার্মিক’ যুবকরা। ধর্মের অজুহাত দেখিয়ে তারা বীরদর্পে এসব হীন কাজ করছে। প্রথমে আসি মুরব্বিদের কথায়। এরা হলো তারা, যারা জানে না একজন মানুষ বা একজন নারীর পোশাক, চলাফেরা সম্পূর্ণই তার নিজস্ব ব্যাপার। এ রাষ্ট্র তাকে সাংবিধানিকভাবে সেই অধিকার দিয়েছে। সেখানে অন্য আরেকজনের হস্তক্ষেপ করা শুধু আইনের লঙ্ঘনই নয়; সেটা সভ্যতা, ভব্যতার চরম লঙ্ঘন। এ তথাকথিত মুরব্বি মানুষদেরই সেই জ্ঞান, বিবেক কিংবা প্রজ্ঞা নেই। আর জ্ঞান-বিবেক জাগ্রতের জন্য সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা দরকার, সেটা হলো শিক্ষা; যে শিক্ষা এ তথাকথিত মুরব্বিদের নেই। তারা নিতান্তই অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত শ্রেণির মানুষ। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, এ ধরনের ঘটনা আজ পর্যন্ত যে ক’টি ঘটেছে, যা দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছে, সেগুলো কি দেশের কোনো সুশীল শ্রেণির মানুষ অর্থাৎ কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা কোনো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ঘটিয়েছেন? না, তারা এ ঘটনাগুলো কোনোদিনই ঘটাতে পারেন না। এর আগে ২০২২ সালের ১৮ মে, নরসিংদী রেলস্টেশনে ঢাকা থেকে যাওয়া এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে পোশাকের অজুহাতে বেদম মারধরের ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছিল। তরুণীটির ওপর এতটাই হিংস্রতা হয়েছিল যে, তার গায়ের টি-শার্টটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। সে ঘটনার মূল হোতা ছিল বোরকাপরিহিত মার্জিয়া বেগম নামের স্থানীয় এক বয়োজ্যেষ্ঠ নারী, যিনি ওই এলাকায় ঘটকালি পেশায় নিয়োজিত। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্থানীয় কিছু বখাটে, মাদকাসক্ত যুবক। এ রকম আরও বেশকিছু ঘটনার উদাহরণ আছে, যেসব ঘটনার মূল হোতা এই শ্রেণির মানুষেরা। সব ঘটনাই মিডিয়ায় আসে না। রাস্তাঘাটে, বাসে চলাফেরার সময় বিভিন্ন সময় লক্ষ করেছি বাসে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের পোশাকের প্রতি একশ্রেণির মুরব্বি মানুষের তীর্যক মন্তব্য। এরাও এই বিশেষ শ্রেণির মানুষ।
এবার আসি এসব ঘটনার জন্য দায়ী তথাকথিত ‘ধার্মিক’ যুবকদের সম্পর্কে। এরা কারা? সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে ঘটনাটা ঘটে গেল, এ ঘটনার অভিযুক্ত কে এই যুবক? ওই যুবক প্রথমে ঢাবি ছাত্রীর কাছে নিজেকে ঢাবির একজন ছাত্র হিসাবে পরিচয় দিয়েছিল। কিন্তু ঢাবির একজন ছাত্র একজন তরুণীকে তার ওড়না নিয়ে কখনোই ওই ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য করতে পারে না। এটা তার শিক্ষার সঙ্গে কখনোই ম্যাচ করে না। ওই ছাত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী যেটা ওই ছাত্রীও অনুমান করতে পেরেছিল। পরে জানা গেল অভিযুক্ত মোস্তফা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের একজন সহকারী বাইন্ডার। এবার ঠিক আছে। এর আগে গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এক তরুণীকে পোশাকের অজুহাতে মারধর এবং কান ধরে ওঠবস করার ঘটনার একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল এবং দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছিল। সে ঘটনারও হোতা ছিল ফারুকুল ইসলাম নামক স্থানীয় এক ‘ধার্মিক’ যুবক। আমি যদি গোষ্ঠী বা শ্রেণি হিসাবে চিন্তা করি, তাহলে এই ‘ধার্মিক’ যুবকরা কারা? স্বল্প শিক্ষিত এসব যুবক কি আসলেই ধার্মিক? না, এরা আসলে নিজেকে ধার্মিক পরিচয়দানকারী একশ্রেণির ‘নারী উত্ত্যক্তকারী’।
প্রশ্ন হলো, গত শতাব্দীর সত্তর দশক, আশির দশক, নব্বইয়ের দশকেও দেশের রাস্তাঘাটে পোশাকের কারণে নারীর প্রতি যে সহিংসতা, বিদ্বেষ দেখা যায়নি, সেটা এ শতাব্দীর বিশ দশকে এসে কেন দেখা যাবে? আরব দেশ, আফ্রিকা, এমনকি ইউরোপ অঞ্চলের কিছু মুসলিম দেশসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্ব যখন নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার ব্যাপারে অনেক বেশি উদার, অনেক বেশি সিভিলাইজড; সেখানে আমাদের দেশ কেন ক্রমান্বয়ে পেছনের দিক যাচ্ছে? আমাদের এ অবস্থা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্য সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। শ্রেণি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে যারাই এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এর আগে নারীর পোশাক নিয়ে দেশে যে কয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলোর যদি সঠিক বিচার হতো, যদি অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যেত, তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হতো। কিন্তু তা হয়নি। এমনকি সম্প্রতি ঢাবিতে ছাত্রী উত্ত্যক্তের এত বড় একটা ঘটনা ঘটার পরও সরকার একেবারেই নিশ্চুপ ছিল। রাজনৈতিক কারণে সরকারের নির্লিপ্ততা কোনোমতেই কাম্য নয়। সরকারের এ নির্লিপ্ততা দেশকে ভবিষ্যৎ সংকট, বিভাজন ও সহিংসতার দিকে ঠেলে দেবে। একমাত্র আইনের শাসনই, আইনের কঠোর প্রয়োগই দেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, জনগণের জানমাল এবং নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
প্রাবন্ধিক