
ছবি: সংগৃহীত
আমাদের দেশে মূলত দীর্ঘদিন থেকেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে টালমাটাল অবস্থা চলছে। যার ফলে রাষ্ট্রের প্রতিটা ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো ইস্যুতে মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ কিংবা কর্মবিরতি কর্মসূচি হতে দেখা যাচ্ছে। সর্বত্র বৈষম্য-বঞ্চনার কাহিনি। এ যেন মাৎস্যন্যায়ের চেয়ে শোচনীয় পরিস্থিতি। মাৎস্যন্যায় বলতেই প্রাচীনকালে রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকে পাল রাজবংশের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত বিরাজমান অরাজকতাপূর্ণ সময়কালকে চিত্রায়িত করে। ইতিহাস বলে, সেই অরাজক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করে দীর্ঘদিন শাসন করে পাল বংশ।
মধ্যযুগে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দিল্লি সালতানাতের সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ (১২৩৩-১২৩৬) তার বিশ্বস্ত চল্লিশ ক্রীতদাস নিয়ে চল্লিশ চক্র গঠন করেন। এ চক্রের সদস্যরা সুলতানকে সর্বক্ষেত্রে সহায়তা করত। সুলতান ইলতুতমিশের মৃত্যুর পরপরই চল্লিশ চক্রের সদস্যরা রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যে, সালতানাতের পরিচালনায় প্রায়শ হস্তক্ষেপ করতেন। চল্লিশ চক্রের কথার বাইরে গেলে সেই সুলতানকে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্যকে সুলতান নির্বাচন করতেন। এভাবে দীর্ঘ ত্রিশ বছর দক্ষ শাসকের অভাবে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এমন বিশৃঙ্খল সময়ে গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২৬৬-১২৮৭) দিল্লির সিংহাসন আরোহণ করেন। ক্ষমতায় আসামাত্র বিশৃঙ্খলা ও আরাজকতা দমনে তিনি blood and Iron Policy অর্থাৎ রক্তপাত ও কঠোর নীতি গ্রহণ করেন। এমনকি সুলতান বলবন নিজেও চল্লিশ চক্রের একজন সদস্য হলেও প্রথমেই সেই চক্রকে সমূলে উৎপাটন করেন। গ্রহণ করেন চমকপ্রদ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি। মূলত রক্তপাত ও কঠোর নীতির ফলে দিল্লিতে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
ইতিহাসের পালাক্রমে ভারতবর্ষ (পরবর্তীতে পাকিস্তান) কর্তৃক দীর্ঘ শাসন-শোষণের পর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে যাত্রা। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েও আমাদের দেশে কাঙ্ক্ষিত সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করা অতীব জরুরি, যা এখনো অধরা। এর পেছনে বেশ কিছু অন্তরায় কাজ করছে। দেশের রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে, অর্থনীতি চলে গেছে পুঁজিবাদের হাতে। দেশ সেবার পরিবর্তে সম্পদের পাহাড় গড়ে তা বিদেশে পাচারে তারা প্রতিযোগিতায় মত্ত। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, লন্ডন, আস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড কিংবা নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত রাষ্ট্রে টাকা পাচার করে অঢেল সম্পদ ও বাড়িঘর করেছেন। এক্ষেত্রে চাকরিজীবীরাও পিছিয়ে নেই, পাল্লা দিয়ে অবৈধভাবে গড়ে তুলেছে অর্থবিত্ত। সবাই নিজ উন্নতিতে ব্যস্ত। বাস্তবতা এমন, ‘ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র বড়’ নয়, বরং রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে এখন প্রাধান্য দেওয়া হয়। দেশ রসাতলে চলে গেলেও সবাই মুখ বুঝে থাকি। এ দুঃসময়ে এসে মনে পড়ে যায় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথা।
নবাবের পতনের সময় জনগণ নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। অপ্রিয় হলেও সত্য, রবার্ট ক্লাইভ তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সে সময় দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী বাঙালি জনগণ যদি একটি করেও ঢিলও ছুড়ত, তবে রবার্ট ক্লাইভের পরাজয় অত্যাবশকীয় হতো; কিন্তু তা হয়নি। যার ফলে, দীর্ঘ দুইশ বছর ইংরেজদের শৃঙ্খলে আমাদের আবদ্ধ থাকতে হয়েছে। আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উপদিষ্ট ব্যক্তিরা বাজারের গাইড বইয়ের মতো একের ভেতর সব। তারাই রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, সম্পাদক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনোভাবে রাষ্ট্রের কোন পদে গেলেই কিছুদিনের মধ্যে আঙুল ফুলে কলাগাছ। রাজনীতি করার সুবাদে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সব শেষ করে দেওয়ার দৃশ্য হরহামেশাই সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে।
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তীতে ব্যাংকগুলোর এমন করুণ অবস্থা লক্ষ করা গেছে, যা কোনোভাবে কাম্য নয়। বিগত সরকার নামে-বেনামে প্রকল্প ঋণ গ্রহণ, নানাভাবে লুটেপুটে ব্যাংকগুলোকে প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় নিয়ে গেছে। অন্যদিকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাজারগুলো দখল করে ফেলছে। এর ফলে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতায় ঠিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র ভঙ্গুর অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশগুলো এখন বহু দেশের জন্য রোল মডেল। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীলতা ছাড়া দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যেক উপদেষ্টা কতটুকু সজ্জন-এটা বড় কথা নয়; কথা হচ্ছে, তারা কতটুকু দক্ষতা দেখাতে পারছেন, কতটুকু জুলাই বিপ্লবের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছেন। এটাই দেখার বিষয়। বাংলার মানুষের বহু প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে তিনি অভাবনীয় কিছু করে যাবেন, এমনই প্রত্যাশা বাংলার জনতার।
প্রভাষক, গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ, ময়মনসিংহ

