Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

মানবতার জন্য যা অভিশাপ যুদ্ধক্ষেত্রে তা বীরত্ব

Icon

মো. মুমিনুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানবতার জন্য যা অভিশাপ যুদ্ধক্ষেত্রে তা বীরত্ব

ছবি: সংগৃহীত

অদ্যাবধি পৃথিবীর ইতিহাসে যত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, সেখানে কেউই আসলে পরাজিত কিংবা বিজয়ী হয়নি! বরং প্রতিটি যুদ্ধেই মানবতা চরমভাবে পরাজিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় আমরা বহু যোদ্ধার বীরত্বগাথা দেখতে পাই। যুগ যুগ ধরে সাহিত্য, লোকগীতি, মঞ্চনাটক ও কবিতায় যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অবদানকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, যুদ্ধের এ গৌরবান্বিত ধারণাটি যুদ্ধের এক ভয়াল ও অন্ধকার সত্যকে আড়াল করেছে। এ সত্যটি হলো, যুদ্ধ সর্বদাই মানবতার জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। বীরত্বের স্তুতিনামা বরাবরই নিরীহ মানুষের মৃত্যু, ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী, বিবর্ণ জনপদ, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ক্ষতির চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। যুদ্ধের পক্ষে যে কোনো যুক্তির ঊর্ধ্বে এটি ধ্বংস, যন্ত্রণা ও বর্বরতার প্রতীক। দৃষ্টান্তস্বরূপ: ট্রয় নগরীর যুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ, চীনের তাইপিং বিদ্রোহ; সাম্প্রতিককালে সিরিয়া, আফগান, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল ইত্যাদি যুদ্ধ মানবজাতিকে কোটি কোটি মানুষের লাশ ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। এসব যুদ্ধে যোদ্ধাদের যত বড় বীরত্বের গল্পই থাকুক না কেন, যুদ্ধগুলো মানবজাতিকে ইতিবাচক কোনো কিছু দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের ধারণা প্রায়ই সহিংসতাকে স্বাভাবিক হিসাবে তুলে ধরে। কিন্তু সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণই মানবজাতির জন্য ভয়াবহ ও দুর্বিষহ ভবিষ্যৎকে ত্বরান্বিত করে। যখন বীরত্বের খোলসে সহিংস আচরণ, বর্বর হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার তারিফ করা হয়, তখন তা পরবর্তী প্রজন্মকে অমানবিক বীরত্বের জন্য উৎসাহিত করে। যখন হত্যাকাণ্ড সাহসিকতার সমার্থক হয়ে ওঠে, তখন এটি মানবজীবনের পবিত্রতাকে কলুষিত করে। যেমনটা দুটি বিশ্বযুদ্ধে দেখা গিয়েছিল। অবশ্য এ বীরত্বেরও একটা নেতিবাচক দিক রয়েছে। যুদ্ধের কঠিন বাস্তবতাকে আড়াল করে সৈনিক কৃর্তক হত্যাকাণ্ডের তারিফ করার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল স্বরূপ পৃথিবীতে সংঘটিত হচ্ছে এত যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রাণহানি।

যদিও বাহ্যিকভাবে আমরা দেখি, যুদ্ধে একদল বিজয়ী ও অন্যপক্ষ পরাজিত হয়েছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, এ বিজয় কিসের বিনিময়ে? উত্তর হচ্ছে-অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, বহু মানুষের অসহায় পঙ্গুত্ব, অর্থনীতির পতন, জাতীয় জীবনে অস্থিরতা ও নিরাপদ আশ্রয়স্থলের জন্য নিরুপায় সাধারণ মানুষের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করার বিনিময়ে। যা যুদ্ধের যে কোনো ইতিবাচক অর্জনের ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি বিজয়ী যোদ্ধারাও বাকি জীবনটা যুদ্ধের মানসিক ক্ষত বহন করে চলেন। প্রতিটি যুদ্ধেই কে হারবে আর কে জিতবে, তা অনির্ধারিত হলেও এটা নির্ধারিত যে, যুদ্ধে মানবতা পরাজিত হবে। অর্থাৎ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিজয়ীরাও যুদ্ধে পরাজয়ই বরণ করে। মোদ্দাকথা, বিজয়ী ও পরাজিত শক্তি উভয়ের জন্যই যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি হলো পরাজয়, ক্ষতি ও নৈতিকতার অবক্ষয়।

যুদ্ধের পর বীরত্বকে উদযাপন করা কখনো কখনো প্রতিশোধ পরায়ণতা ও ঘৃণার চক্রকে উসকে দিয়ে নতুন সংঘাত সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যখন অক্ষশক্তি পরাজিত হয়, তখন তাদের ওপর কিছু লজ্জাজনক শর্ত আরোপ করা হয়। অন্যদিকে মিত্রশক্তি তখন যুদ্ধ জয়ের উল্লাসে ব্যস্ত। তাদের এ বিজয়োল্লাসই অক্ষশক্তিকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে, যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা পৃথিবীকে প্রায় ৭ কোটি মানুষের মরদেহ উপহার দেয়। এভাবেই প্রতিশোধের চক্র চলতে থাকে বিধায় পুরো মানবজাতিই ভোগান্তির শিকার হয়। অথচ, যুদ্ধের রসদ ক্রয় না করে এ অর্থ যদি একটি দেশ তার দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসারসহ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যয় করতে পারে, তাহলে তা দেশটিকে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণে সহায়তা করবে।

বীরত্বের অনেক সমালোচনা করা হলো, তাহলে কি বীরত্ব প্রদর্শন অপরাধ? মোটেও না; তবে সত্য, ন্যায়, মজলুমকে রক্ষা, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য বীরত্ব লালন করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, শান্তিপূর্ণ সমাধানই মহান বীরত্বের প্রতীক। অপরদিকে, পৈশাচিক বীরত্ব প্রদর্শন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধ অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধ। আমরা বরং প্রকৃত বীরত্বের ধারণাকে বিশ্লেষণ ও উৎসাহিত করতে পারি। প্রকৃত বীরত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে নয়; বরং এটি শান্তি, বোঝাপড়া, সহমর্মিতা ও সহাবস্থানের পথে বিদ্যমান। হিরোইজমের চলমান ও প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞা পুনঃসজ্ঞায়িত করার এখনই সময়, যা যুদ্ধবিগ্রহকে নিরুৎসাহিত করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বাতলে দেবে। যারা সমস্যার সমাধান রক্তপাতহীনভাবে করতে পারে, বিভক্ত জাতিকে শান্তিপূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেন, তারাই প্রকৃত বীর। বীরত্বকেও এভাবেই পুনঃসজ্ঞায়িত করা জরুরি। মানবজাতি কেবল তখনই তার ভয়ংকর যুদ্ধবিধ্বস্ত অতীত থেকে মুক্তি পেতে পারে।

শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম