শিশু মুনতাহার হত্যাকারীদের শাস্তি চাই
কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে উদ্বেগজনক হারে হত্যাসহ নানা অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে বাড়ছে আতঙ্ক আর শঙ্কা। সম্প্রতি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার সিলেটের শিশু মুনতাহার কথাই বলা যেতে পারে। শিশুটির সন্ধানে ফেসবুকে ব্যাপক পোস্ট করা হয়। বলা যায়, সারা দেশেই এ নিখোঁজের ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গত ১০ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনকে (৬) হত্যার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় পুলিশ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ তদন্তের সূত্র ধরে মুনতাহার সাবেক গৃহশিক্ষিকা শামিমা বেগম মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। একপর্যায়ে মার্জিয়া স্বীকার করে, গত ৩ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে তাদের ঘরে শিশু মুনতাহাকে গলা টিপে ও বস্তাচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সবাই কানাইঘাটেরই বাসিন্দা ও শিশু মুনতাহার প্রতিবেশী। প্রসঙ্গত, শিশু মুনতাহা সেদিন সকালে বাবার সঙ্গে স্থানীয় একটি ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরে দুপুরের দিকে বাড়ির পাশে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে যায়। কিন্তু বিকালে সে বাড়ি না ফিরলে পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি করে কোথাও তাকে পায়নি। সন্ধানকালে ভোররাতে মুনতাহার বাড়ির পাশেরই একটি খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
আসলে এসব ঘটনা নৈতিকতার চরম বিপর্যয়েরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটি ঘটনার পরপরই আরেকটি ঘটনার জন্ম হচ্ছে। খুনের পাশাপাশি অনেক শিশু পাশবিকতা ও বর্বরতার শিকারও হচ্ছে। এমন সামাজিক অপরাধ, সহিংসতা বা মানুষের মধ্যে ফুটে ওঠা নৃশংসতার চিত্র প্রায় সর্বত্র। পত্রিকার পাতা ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় এ সম্পর্কিত খবর চোখে পড়ছে নিয়মিত। বিভিন্ন সময় এ ধরনের ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মানুষের মাঝে বিদ্যমান মানবিক গুণাবলি লোপ পেয়ে হিংস্রতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অপরাধীরা সর্বত্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হেন অপরাধ নাই, যা তারা করছে না। কখন কে এসব অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হয়, বলা মুশকিল। অভিভাবকসহ সমাজ ও দেশের সাধারণ মানুষকে তটস্ত থাকতে হয় সর্বক্ষণ। নানা মহল থেকে প্রতিক্রিয়া হলেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি দেখা যায় না। সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর যে ধকল গেছে, তা থেকে উত্তরণ ও পরিবেশ স্বাভাবিক হতে সময় লাগছে। পাশাপাশি বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণেও খুনের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর সাহস পায়। ধরা পড়লেও সাজা কখন হয়, তা নিয়ে আছে নানা শঙ্কা। তাছাড়া রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের আশকারা পেয়ে অপরাধীরা দ্বিগুণ উৎসাহে অপরাধ করার দুঃসাহস দেখায়। মানুষের মাঝে এ ধরনের হিংস্র মনোভাব কীভাবে জাগ্রত হয় যে, নিজের আপনজনকেও হত্যা করতে পারে? এ ধরনের সব ঘটনা গোটা জাতিকে করছে স্তম্ভিত, শঙ্কিত।
সমাজে মূল্যবোধের বড়ই অভাব। মানুষের মাঝে নৈতিক চরিত্রের সংকট চলছে। সভ্য যুগে এমন নৃশংসতা কোনোভাবেই মানানসই নয়। যেসব কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। অপরাধী যেমন অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ পাবে না, তেমনি মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবার থেকেই মূল্যবোধের শিক্ষা শুরু করতে হবে। নৈতিক মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি অপরাধের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সমাজ থেকে নিন্দনীয় ও গর্হিত এসব কাজ দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। কীভাবে এসব অপরাধ থেকে মুক্ত থাকা যায়, তার কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। নৈতিক চরিত্র গঠন, মূল্যবোধের প্রচার, ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ এবং সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধানকে সংস্কার করে ইতোমধ্যে ধর্ষণ ও খুনের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ দেওয়ার বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনের বাস্তবায়নে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ন্যায়বিচার ও বিচার প্রক্রিয়া তরান্বিত করতে পারলে ধর্ষক, খুনি, সন্ত্রাসী-যেই হোক অপরাধ করার সাহস পাবে না। রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালীদের অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। অপরাধীদের শেকড় উপড়ে ফেলতে পারলে সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। নিজের আপনজনের কাছেও যদি মানুষ নিরাপদ না থাকে, তাহলে তারা যাবে কোথায়? মানুষের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সমাজে মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন তার নিরাপত্তা, যার মাধ্যমে সে নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারবে। এখনই থামাতে হবে নৃশংস এসব খুনের ঘটনা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া শিশু মুনতাহার নৃশংস খুনের সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি। আমরা একটি সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চাই। এজন্য অন্যসব অপরাধের পাশাপাশি খুনের ঘটনার বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কঠোর ও কঠিনতম শাস্তি হোক সব খুনির।
শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক