Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

জীবনানন্দের ‘রূপসী’ বাংলায় হালদাররা যেভাবে মালদার হচ্ছেন

Icon

লাইজু আক্তার

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জীবনানন্দের ‘রূপসী’ বাংলায় হালদাররা যেভাবে মালদার হচ্ছেন

তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। কবি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে বোধহয় প্রথম জানতে শুরু করেছি। তিনি বাংলার রূপকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তার লেখা পড়ে আমি স্কুলের পরীক্ষায় রচনা লিখেছিলাম-সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, রূপের নেইকো শেষ, এই আমাদের দেশ; বাংলাদেশ। আমার দেশ বাংলাদেশকে তখন আসলেই এ রকম মনে হতো। তখন মনে করতাম-কবি জীবনানন্দ দাশ এ দেশের রূপ সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।

সকাল আটটা বাজলেই স্কুলের উদ্দেশ্যে বই হাতে তৈরি হয়ে যেতাম। আমাদের স্কুলটা ছিল ছোট্ট একটা নদী পার হয়ে, কয়েকটা ফসলের খেত মাড়িয়ে তবেই স্কুলের মাঠে পা রাখতে পারতাম। শীতকালে ক্ষেতে চাষ হতো সরিষা। শিশির পড়ে থাকত ক্ষেতের আইলগুলোতে, যা আমার ছোট্ট ছোট্ট পা দুটোকে ভিজিয়ে দিত। আহা! কী মায়াময়, মধুর ছিল সে দিনগুলো-যে দিনগুলোর সঙ্গে জীবনানন্দের লেখার বেশ মিল পেতাম।

এর কিছুদিন পর জানতে পারলাম-এ দেশে এক সময় গোয়ালভরা গরু ছিল, ছিল মাঠ ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ। এসব এত বেশি ছিল যে, প্রতিবেশী দেশের কয়েকশ লোককে প্রতিবেলা দাওয়াত করে খাওয়াতে পারত বাংলার মানুষ। কোনো অভাব-অটন ছিল না।

এরপর হঠাৎ নাকি ‘বর্গী এলো দেশে’। তারা দেশে এসে রাজত্ব করতে শুরু করলেন। শুরু হলো নীল চাষ। বাংলার মানুষ দরিদ্র হতে লাগল; অনাহারে-অর্ধহারে থাকতে লাগল। তখন দেশ হয়ে গেল বেগম রোকেয়ার ‘পাছায় জোটে না ত্যানা’-র মতো। এ বর্ণনাগুলো বইয়ে পড়েছি গত ৭-৮। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে যা এখনো পড়তে হচ্ছে। ব্রিটিশরা এ দেশের মানুষের রক্ত চুষে খেয়েছে, এ দেশকে উৎপাদন কেন্দ্র বানিয়ে প্রচুর টাকা আয় করে নিজের দেশে নিয়ে গেছে নিজেদের উন্নয়ন করতে। আর বাংলার মানুষ থাকত অনাহারে।

এসব বর্ণনা দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র কেন এখনো অন্যান্য রাষ্ট্রের চেয়ে পিছিয়ে, কেন এ বাংলায় তেমন উন্নয়ন হয়নি-তার ইতিহাস লেখা হয়েছে বইয়ের পাতায়। আমি এ বিষয়গুলো বিশ্বাস করি; বিশ্বাস করি জীবনানন্দের রূপসী বাংলা এভাবেই লুট হয়েছে। সেদিক থেকে ব্রিটিশদের চোর-ডাকাত বলাটাই শ্রেয় হবে। কারণ, তারা বাংলার শস্য চুরি করে, ডাকাতি করে নিজেদের গোলা ভরেছে। নিজেরা হয়েছে বাদশা আর আমরা নিরীহ বাঙালি হয়েছি প্রজা। আমাদের সেই সেদিনের কুঁজো হয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড আজ এতদিন পর এসেও কুঁজোই রয়ে গেল।

আহা! জীবনানন্দের রূপসী বাংলার রস শুকিয়ে রুক্ষ হয়ে গেল। এ ইতিহাসগুলো ঘুরে ঘুরে পড়ে, জীবনানন্দের বর্তমান বাংলা দেখে অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে বহু প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। বলতে ইচ্ছে করে-স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পর এসেও আদৌ কি আমরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে রক্ষা পেয়েছি?

নাকি পাবো? সত্য বলতে কী, আমার জন্ম জীবনানন্দের স্বাধীন রূপসী বাংলায় এবং আমি স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের একজন হওয়ার পরও আমার মনে হয়-আমরা এখনো ব্রিটিশদের হাত থেকে রক্ষা পাইনি। কারণ, স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী বাংলাদেশ যেমন ছিল, বর্তমানেও কিছু ক্ষেত্রে তাই আছে। ব্রিটিশরা এক সময় যেমন আমাদের প্রায় সব টাকা নিয়ে যেত, এখনো ঠিক তেমন ঘটনাই ঘটছে। তথাকথিত কিছু ব্রিটিশ-বাঙালি বাংলাদেশের অর্থ লুট করে নিয়ে বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে, সুইস ব্যাংক ভরছে।

এই তো কিছু দিন আগেই এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল পি কে হালদার নামে এক ব্যক্তির মালদার হওয়ার ঘটনা। বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও তিনি ব্রিটিশদের মতো বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। তাহলে এ ভদ্রলোক কি ব্রিটিশদের কাতারে পড়েন না? এরকম ‘হালদার’ থেকে ‘মালদার’ হয়ে যাওয়া বাঙালিরা কি ব্রিটিশের প্রেতাত্মা নয়?

আমরা ইতিহাসের বইগুলোতে শুধু পড়ি-ব্রিটিশরা চোর, আমাদের শস্য চুরি করে নিয়ে গেছে তাই আমরা গরিব। আমাদের অর্থনীতির চাকা দেবে গেছে। আদতে আমাদের শস্য এখনো এভাবেই চুরি হচ্ছে। এখনো দুর্নীতি, ঘুস, কালোবাজারির মাধ্যমে দেশের অর্থ অন্যত্র, অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। হায় রে! ব্রিটিশরা বাঙালিদের শেখাতে চাইল, কীভাবে অন্য দেশের অর্থ নিজের দেশে নিয়ে যাওয়ার পর তা দেশের উন্নয়নে ব্যয় করতে হয় আর বাঙালিরা বুঝল-কীভাবে নিজ দেশকে লোপাট করে অন্য দেশে গিয়ে সুখে থাকা যায়!

খুব আফসোস হয়-দেশে এখনো দুর্নীতি, ঘুস, কালোবাজারির রমরমা ব্যবসা। অথচ কী আচানক কথা- জীবনানন্দ মহাশয় এ বাংলায়ই পুনরায় ফিরে আসার ইচ্ছে পোষণ করেছেন! আমি জানি না, ওপারের সুদূরতম ঠিকানা থেকে তিনি আমার এ লেখা পড়ার পর ‘আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়’ বলবেন কিনা!

শিক্ষার্থী, নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ

mstlaijua@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম