
প্রিন্ট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৫২ এএম
ভয়ের জনপদে প্রাণের উচ্ছ্বাস

আমিরুল ইসলাম কাগজী
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
কতদিন পর গ্রামের বাড়িতে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করলাম, সেটা এখন মনে পড়ছে না। বিশেষ করে গত ১৭ বছর গ্রামে এক ধরনের দলাদলির কারণে ঈদ জামাত থেকে বিরত রেখেছিলাম নিজেকে। এবার গ্রামের বেশ কয়েকজন মুরব্বি টেলিফোন করে জানালেন, আমরা সবাই এক ময়দানে ঈদুল ফিতরের জামাত করব। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার লক্ষ্মীখোলা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী কাগজী বাড়ির মাঠে একসঙ্গে জামাত করেছি, একে অপরের সঙ্গে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করেছি। আমার জন্মের পর থেকেই এ দৃশ্য আমি দেখে এসেছি। ঈদুল আজহার কুরবানি হতো এ মাঠে। গ্রামের যত মানুষ কুরবানি দিত, সবাইকে এ মাঠেই আসতে হতো। যারাই কুরবানি দিত, সবাইকে সমান তিন ভাগ করে মাংস এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের জন্য এক জায়গায় রাখা হতো। দুই ভাগ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিত। গ্রামে যারা কুরবানি দিতে পারত না, তাদের একটা তালিকা তৈরি করা হতো কেন্দ্রীয়ভাবে। দিনশেষে যত মাংস জমা হতো, তা কড়ায়গণ্ডায় হিসাব করে বণ্টন করা হতো। আমাদের আশপাশের অন্যান্য গ্রামে কেউ উঠানে, কেউ নিজের খামারে গরু কুরবানি করত। সেই ছোটবেলা থেকেই আমাদের গ্রামের এ প্রথা চালু থাকার বিষয়টি নিয়ে গর্ব, ঘরে আলোচনা করতাম।
স্কুল-কলেজের পাঠ চুকিয়ে যখন ঢাকা শহরে এলাম, সেখানে এসেও দেখি আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের মতোই মানুষজন তার বাড়ির সামনেই কুরবানি দেয়। যার যার মতো কুরবানির মাংসের একটা অংশ গরিব-মিসকিনদের মাঝে ভাগ করে দেয়। আমাদের লক্ষ্মীখোলা গ্রামের এই যে একতাবদ্ধতা, এটা আর পাঁচ-দশটা গ্রামের চেয়ে একটু ভিন্ন। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে সেই একতাবদ্ধতা ও আনন্দধারায় ছেদ পড়তে থাকে। এরই একপর্যায়ে এসে গ্রামের মাঝ বরাবর কাগজী বাড়ির মাঠখানা দলীয় রোষানলে পড়ে ঈদ জামাত আদায়ের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ময়দানের জমায়েত চলে যায় মসজিদে। চিত্রটা তুলে ধরছি এ কারণে যে, গত ১৭ বছর স্বৈরাচারী শাসনামলে মানুষকে কীভাবে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে, তার একটি নমুনা আমার গ্রাম লক্ষ্মীখোলা। গ্রামের মুরব্বিরা যখন আমাকে দাওয়াত দিলেন, তখন আমি তাদের বারবার জিজ্ঞেস করেছি, আমরা একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারব কিনা। তারা আশ্বস্ত করলেন। এ সমঝোতার কাজটি যারা করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম লক্ষ্মীখোলা কলেজিয়েট স্কুলের প্রিন্সিপাল মেজবাহুর রহমান কাগজী, শফিকুল ইসলাম গাজী, হারুন, নজরুল প্রমুখ। তাদের ধন্যবাদ জানাই আন্তরিকভাবে। তাদের সঙ্গে ঈদের ছুটি বাড়িতে কাটানোর জন্য মনস্থির করে ফেলি।
ঈদের জামাতে আমরা সমবয়সি যারা, তারা সবাই মুরব্বি হয়ে গেছে। পরবর্তী বংশধর যারা এসেছে, তাদের নাম তো বলতে পারব না, এমনকি চেহারা দেখেও চিনতে কষ্ট হয়েছে। তারা যখন বাপ-চাচাদের নাম বলেছে, তখন তাদের চিনতে পারা, তাদের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে কথা বলার সৌভাগ্য হলো। ঈদের জামাতে সবার অনুরোধে কিছু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তখনো বলেছি, বিগত দিনগুলোতে মানুষের আনন্দ প্রকাশের পথকে কীভাবে রুদ্ধ করা হয়েছে, বলেছি কীভাবে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষ ভোট দিতে পারেনি কিংবা ভোট দিতে দেওয়া হয়নি, সে কথাটা বলেছি। আমার কাছে মনে হলো, গ্রামের মানুষ মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনেছেন।
ঈদের জামাত শেষ করার পর বিকাল ৩টার দিকে বিএনপি-ছাত্রদল-যুবদলের নেতাকর্মীরা সুন্দরবন ঘুরতে যাবে বলে তাদের নিয়ে চলে যাই কয়রার শেষ প্রান্ত বেতকশিতে (কাঠকাটা)। আমাদের বহরে যুক্ত হয়েছিলেন একজন বঞ্চিত সচিব তৌহিদুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন যুবদল নেতা বিপ্লব, আমিনুল ইসলাম বজলু, হারুন, টুকু, সাজিদ, রাকিব, তৌকির, আবিদ। কাঠকাটায় আমাদের জন্য চায়ের আয়োজন করেছিলেন কয়রা বিএনপি নেতা তরুণ তুর্কি এমএ হাসান। তার সঙ্গে ছিলেন যুবনেতা এহসানুর রহমান, আকবর হোসেন, আবুল কালাম কাজল, কয়রা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মাহমুদ হাসান, বিএনপি নেতা কালাম আজাদ, সালাউদ্দিন, লিটন, মনজুর মোরশেদ, অ্যাডভোকেট প্রমথো, কবির মাস্টার, কহিনুর ইসলাম, অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন, ছাত্রদল নেতা আলাউদ্দিন, আবু নাঈম, মাশরাফি, রুহুল আমিন বাবুল, রানা, মিনার, আরিফুল। সচিব তৌহিদুর রহমানের ইচ্ছা প্রকাশের পরপরই পড়ন্ত বিকালে নৌকা নিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করেছি।
ঈদের পর দুদিন এলাকার বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়িয়েছি। ঈদগাহ ময়দানগুলো তখনো সুন্দর করে সাজানো। মাঠে মাইক বাজছে। নানা রঙের সাজগোজ করা ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছে। নানা রকম প্রতিযোগিতা হচ্ছে। সেগুলো আমাদের চোখে পড়ল কয়রা যাওয়ার পথে। পরদিন একই অবস্থা। এলাকার লোকজন ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাচ্ছেন এবং আনন্দ উৎসব করছেন। ঈদের দ্বিতীয় দিন বুধবারও ছিল জমজমাট। চাঁদখালি ইউনিয়নের দেবদুয়ার শেখপাড়া পল্লী উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে চারদলীয় জিয়া স্মৃতি ভলিবল টুর্নামেন্টসহ লাঠি খেলা, শারীরিক কসরত এবং নানারকম ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সংস্থার সভাপতি আসাদুজ্জামান ময়নার সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মন্টু, যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মোমরেজুল ইসলাম, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের ডাইরেক্টর সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম কাগজী, পাইকগাছা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. আবদুল মজিদ, পাইকগাছা পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আসলাম পারভেজ, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব ইমদাদুল হক এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন শেখ আবদুল হাদী। অনেক রাত পর্যন্ত চলেছে এ অনুষ্ঠান। সবার মাঝে সে কী আনন্দ, বলে শেষ করা যাবে না। এরপর যখন পাইকগাছা অতিক্রম করে খুলনার দিকে আসছিলাম, তখন দেখলাম পাইকগাছা সরকারি কলেজ মাঠে চলছে ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। সেখানকার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য তুষার কান্তি। সেটাও চলেছে রাত ধরে। তাদের এ আয়োজনকে সম্মান না জানিয়ে বসে থাকতে পারলাম না। তাই গাড়িতে বসেই আস্তে আস্তে লিখতে থাকলাম আমার পাঁচদিনের পাইকগাছা কয়রার মাটি ও মানুষের ভালোবাসার কথা।
এসএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রসহ রেকর্ডপত্র অনুযায়ী এদিন (২ এপ্রিল) ছিল আমার জন্মদিন। পাইকগাছা ছেড়ে খুলনা আসার পথে মাহমুদকাটি আদর্শ লাইব্রেরির কর্ণধার সাইদুর রহমান নাছোড়বান্দা। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন লাইব্রেরির পৃষ্ঠপোষক আইউব আলী মোড়লসহ কর্মকর্তাদের নিয়ে। তার ওখানে বসে আমার জন্মদিনের কেক কাটতেই হলো। সঙ্গে ফুলের তোড়া দিয়ে আমাকে শুভেচ্ছা জানানো হলো। তাকে এবং তার পুরো টিমকে আমি জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।
পাইকগাছা-কয়রায় আগেও বহুবার ঘুরেছি। এখানকার মানুষের আতিথেয়তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। সবাই যেন আপনজন। কিন্তু মাঝে ১৫-১৬ বছর অনেকটা পানসে মনে হয়েছে। মানুষ কথা বলতে ভয় পেত। চায়ের দোকানে বসে একটাই আলোচনা ছিল-নাশকতা, নাশকতা আর নাশকতা। পাঁচজন এক জায়গায় বসলেই তারা মনে করত তাদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা হবেই। তাই আলোচনা হতো চুপিসারে। সাংবাদিক হওয়ার কারণে আমার কাছে এসে বসে তারা ঢাকার পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করত। আমি যেটুকু বলতাম, সেটাও যেন মেপে মেপে। কোন কথা বললে ডিজিটাল সিকিউরিটি মামলায় পড়ে যেতে হয় কিংবা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা খেতে হয়-সেটা চিন্তা করতে হতো। তারপরও তারা আড্ডায় বসে সত্যটা শুনতে চাইত। অর্থাৎ ওই সময় গোটা দেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছিল। মানুষ আনন্দ-উৎসব করতে ভুলে গিয়েছিল। মুসলমানদের দুটো বড় উৎসব ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা, সেটাও ছিল পানসে। এবার সেই ঈদে মানুষ প্রাণ ফিরে পেয়েছে। গত বছর জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বিদায় নিয়েছে। শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু বিলীন হয়েছে। মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যাদের রক্তের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, আজকের এই দিনে দাঁড়িয়ে সেই শহিদদের প্রতি জানাই সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান। তাদের পরিবারের প্রতি জানাই আন্তরিক সমবেদনা। সরকারি হিসাবমতে, ৮৫৮ জন শহিদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
আমিরুল ইসলাম কাগজী : সিনিয়র সাংবাদিক