
প্রিন্ট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০:০৭ এএম

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেইক আমেরিকা ওয়েলদি অ্যাগেইন’ (আমেরিকাকে আবারও সম্পদশালী দেশে পরিণত করুন) ঘোষণার আওতায় বাংলাদেশসহ ১৮০টি দেশ থেকে আমদানি পণ্যের ওপর নতুন হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা তার ঘোষণার দিন, অর্থাৎ ২ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর এ হার ৩৭ শতাংশ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্কহার বজায় ছিল। নতুন শুল্কহারের ১৮০টি দেশের অধিকাংশের ওপর ১০ শতাংশ শুল্কহার ঘোষিত হলেও ৬০ দেশের পণ্যের ওপর আরোপিত অধিক শুল্কহার ওই দেশগুলোর ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিবেশী দেশ কানাডা ও মেক্সিকোর ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্কহার গত মাসেই কার্যকর হয়েছে। ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে, কোনো দেশ যদি ভেনিজুয়েলা থেকে তেল বা গ্যাস আমদানি করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ওইসব দেশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্প আরোপ ছাড়াও অন্যান্য কর বসাবে। তবে যেসব দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বর্ধিত হার প্রযোজ্য হবে, তারা যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, তাহলে ওই দেশগুলোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য হারে শুল্ক হ্রাস করবে বলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন।
ট্রাম্পের গৃহীত শুল্কব্যবস্থা সারা বিশ্বে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ, বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য বিশ্লেষক এ নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছেন এবং ভোক্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কারণ বর্ধিত শুল্কহারে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্র চরম অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হবে। চীনের ওপর শাস্তিমূলক শুল্কহার আরোপিত হওয়ায় ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নতুন শুল্কহার আরোপিত হওয়ার ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় একটি দেশের অর্থনীতি পরিচালনায় ইতোমধ্যে ট্রাম্পের ওপর আমেরিকানদের ক্রমহ্রাসমান আস্থায় আরও ধস নামবে।
‘মুডি অ্যানালিটিকস’-এর চিফ ইকোনমিস্ট মার্ক জানদির মতে, ‘পণ্যের উচ্চমূল্য পরিশোধের মাধ্যমে আমেরিকান ভোক্তাদেরই বর্ধিত শুল্কের বোঝা বহন করতে হবে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর চাপানো নতুন শুল্ক আমেরিকার অর্থনীতিকে দুর্বল করবে। কারণ এর ফলে ভুক্তভোগী দেশগুলো আমেরিকান রপ্তানি পণ্যের ওপর পালটা প্রতিশোধমূলক শুল্কহার আরোপ করতে দ্বিধা করবে না।’
নতুন শুল্কনীতি স্বাক্ষরকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদিও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন যে, এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে বহু দশক থেকে চলে আসা অসম বাণিজ্য-ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার নতুন যুগের সূচনা করবে। ট্রাম্পের বিশ্বাস, গৃহীত শুল্কব্যবস্থা আমেরিকানদের বহু ট্রিলিয়ন ডলারের কর হ্রাস করবে, জাতীয় ঋণের বোঝা কমাবে এবং দ্রুত এর ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদ মার্ক জানদির মতে, ‘বর্ধিত শুল্কহার ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রতিশোধের সমন্বয় জাতীয় অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে এবং শেষাবধি দেশ মন্দার দিকে ধাবিত হবে।’
নতুন শুল্কহারের ওপর উইজকনসিনের ‘মারক্যেট ল’ স্কুল’ পরিচালিত জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ৬ জনেরই বিশ্বাস, ট্রাম্পের নীতি দেশে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ ঘটাবে। জাতীয় পর্যায়ের অন্যান্য জরিপেও কমবেশি একই ধরনের ফলাফল এসেছে। আমেরিকান মূলধারার গণমাধ্যমগুলোও ট্রাম্পের শুল্কনীতির সমালোচনায় সোচ্চার। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারণায় জোরের সঙ্গে বলতেন কীভাবে তিনি পণ্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি কতটা কমিয়ে আনবেন। ভোটাররা তার এ প্রতিশ্রুতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তাকে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু এখন তারা হতাশ ও সন্দিগ্ধ যে, পণ্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ট্রাম্পের পক্ষে আদৌ গ্রহণ করা অথবা বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করে তার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পালে অনুকূল বাতাস প্রবাহিত করা সম্ভব কিনা।
করোনা মহামারি চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, ৪০ বছরের মধ্যে তা ছিল সর্বাধিক। ফলে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তি ছিল চরমে। ওই সময়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত বিধিনিষেধের কারণে পণ্য আমদানি হ্রাস পাওয়ায় এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির হয়তো একটি যৌক্তিক কারণ দেখাতে পেরেছিল প্রশাসন। পরবর্তীকালে কিছু কিছু ভোগ্যপণ্যের মূল্য হ্রাস পেলেও তা করোনা পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যায়নি। এজন্য দায়ী ছিল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। ভোটাররা ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি বা বাগাড়ম্বরে বিভ্রান্ত হয়ে তাকে সমর্থন করেছেন। তারা বিশ্বাস করেছিলেন, একমাত্র ট্রাম্পের পক্ষেই দরিদ্র ও সীমিত আয়ের আমেরিকানদের কিছু উপকার করা সম্ভব। কিন্তু তা হয়নি। ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতিতে বরং তা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
অবশ্য কিছু বিশ্লেষকের ধারণা, অন্যান্য দেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিশোধমূলক পালটা শুল্কহার আরোপ না করে, তাহলে ট্রাম্পের শুল্কনীতি আমেরিকান অর্থনীতির জন্য ফলপ্রসূ হবে। ‘সিগনাম গ্লোবাল অ্যাডভাইজরস’-এর ইউরোপ বিষয়ক বিশ্লেষক নিকো ফিটজরয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউজউইক বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার আরোপের প্রতিক্রিয়া অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশকে অহেতুক বাণিজ্যযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার রক্ষণশীল বাণিজ্য এজেন্ডা থেকে পিছু হটবেন এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। এমনকি এ প্রক্রিয়ায় রিপাবলিকান পার্টির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ট্রাম্প পিছু হটবেন বলে মনে হয় না। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক ‘ক্যাটো ইনস্টিটিউটের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ কলিন গ্র্যাবো বলেছেন, যে কোনো কারণে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিপুল বৈপরীত্যের মধ্যেও শুল্কের শক্তির ওপর বিশ্বাস করেন।
তবে মুদ্রাস্ফীতির চাপ, ভোক্তাদের ক্রমহ্রাসমান আস্থাহীনতা এবং স্টক মার্কেটের যখন-তখন ওঠানামার কারণগুলো যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দিগন্তে সম্ভাব্য মন্দার আভাসকে সুস্পষ্ট করে তুলেছে। অনেকে এ সূচকগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সনাতন মিত্র এবং দীর্ঘদিনের শত্রুর বিরুদ্ধে নতুন শুল্কহার সমভাবে প্রয়োগ করাকে আমেরিকার বাণিজ্যনীতি ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা বলে মনে করছেন। এ কারণে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল বুধবারকে ‘আমেরিকার মুক্তি দিবস’ বলে বর্ণনা করেছেন। এর আগে তিনি যখন কংগ্রেসে ভাষণ দেন, সেদিনই শুল্কনীতির রূপরেখা তুলে ধরে এ সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়ার তারিখ স্থির করেন ২ এপ্রিল এবং তার চিরাচরিত রসিকতার সুরে বলেন, তিনি একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তি হিসাবেই দিনটি নির্ধারণ করেছেন, কারণ তিনি ‘এপ্রিল ফুলের দিনের জন্য অভিযুক্ত’ হতে চান না।
বাংলাদেশের ওপর কেমন প্রভাব পড়তে পারে
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কহার, যা সেদেশে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে, সেজন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প। কারণ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। শুল্ক বৃদ্ধির কারণে আমেরিকান বাজারে বাংলাদেশসহ যেসব দেশ তৈরি পোশাক রপ্তানি করে, তাদের পোশাকের মূল্য অনিবার্যভাবে বাড়বে। ফলে তৈরি পোশাকের চাহিদা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা ইতোমধ্যে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আমেরিকান সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শুল্কহার হ্রাসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন শুল্কনীতি ঘোষণা করেন, তখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিমসটেক সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষ্যে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অবস্থান করছিলেন। তিনি বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ সম্পর্কে বলেছেন, সরকার বিষয়টি পর্যালোচনা করছে। আমেরিকান সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন শুল্কহার নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সর্বোত্তম সমাধানে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য এবং এ শিল্প দেশের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত। রপ্তানি আয় ও অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার স্থিতিশীল রাখতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমরা আশা করি।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক