
প্রিন্ট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৫২ এএম
ঈদের আনন্দ সর্বজনীন

মাহমুদ আহমদ
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ববাসীর মাঝে বারবার ফিরে আসে ঈদের আনন্দ। সিয়াম সাধনা ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে অতীতের ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চেয়ে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলার অঙ্গীকারে প্রত্যয়ী হওয়ার এক সফল অনুষ্ঠান এই পবিত্র ঈদ।
বর্তমানে ঈদকে কেবল ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব হিসাবে বিবেচনা করা হয় না, বরং ঈদ আজ সর্বজনীন এক আনন্দের উৎসব। সামাজিক উৎসবগুলোয় আমরা যেমন আনন্দে মাতি, তেমনি প্রত্যেক ধর্মেই রয়েছে বিশেষ কিছু উৎসবমুখর দিন। সেই উৎসবগুলোও আমাদের আনন্দে ভাসায়। ব্যবধান ঘুচিয়ে এক করে। আমাদের দেশেও রয়েছে নানা ধর্ম ও গোত্রের মানুষের বসবাস। ঈদ, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা, বৈসাবি, রাস পূর্ণিমা ইত্যাদি বিশেষ দিনে সবাই আনন্দে মেতে ওঠে। এসব ধর্মীয় উৎসব বৃহৎ অর্থে সামাজিক জীবনাচারেরই অনুষঙ্গ। প্রতিটি উৎসব আমাদের ঐক্যবদ্ধ, বড় ও মহৎ হতে শেখায়। ঈদের আনন্দ দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মাঝেই সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ নিহিত।
মুসলমানের জন্য ঈদ একটি মহা-ইবাদতও। ঈদের ইবাদতে শরিয়ত নির্দেশিত কিছু বিধিবিধান রয়েছে, যা পালনে সামাজিক জীবনে পারস্পরিক আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও বন্ধন সুসংহত হয়। ঈদুল ফিতরের শরিয়তের দিকটি হলো, ঈদের নামাজের আগে ফিতরা ও ফিদিয়া আদায় করা, ঈদগাহে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা, খুতবা শোনা এবং উচ্চৈস্বরে তাকবির পাঠ করা। ঈদে আমাদের দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটে আর পরস্পরের মাঝে ইমানি ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয় এবং নিজেদের মাঝে থাকা হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে এক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যদি এমনটা ঘটে, তাহলেই আমাদের এ ঈদ পালন ইবাদত হিসাবে গণ্য হবে।
আল্লাহতায়ালার আদেশে এক মাস রোজা রাখার পর তার আদেশেই আমরা ঈদের আনন্দ উদযাপন করি। এক মাস রোজা আমরা আমাদের তাকওয়া ও ইমান বাড়ানোর জন্য রাখি। আমরা রমজানের রোজা এজন্যই রাখি, যেন আল্লাহপাকের নৈকট্য অর্জন করতে পারি। এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আল্লাহতায়ালা আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন ঈদ উদযাপন করার। প্রত্যেক বৈধ কাজ, যা থেকে তিনি আমাদের এক নির্ধারিত সময় বিরত রেখেছিলেন, আজ ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে তা করার অনুমতি দিয়েছেন। ঈদ উদযাপন মূলত আল্লাহতায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন আর কৃতজ্ঞতার সর্বোত্তম পন্থা হলো, ধনী-গরিব সবাই একত্রিত হয়ে ঈদগাহে নামাজ আদায় করা। এক মাস রোজা রাখার যে তৌফিক আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন, এরই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ দুই রাকাত নামাজ। তাই বলা যায়, ঈদ কেবল ভালো খাওয়া বা ভালো পরা আর বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় আনন্দ ভ্রমণ করা নয়, বরং কৃতজ্ঞতা আদায়ের জন্য একটা বিশেষ সুযোগ হিসাবে আল্লাহতায়ালা আমাদের ঈদ দান করেছেন। আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে, ঈদ উদযাপনকালে শুধু আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে না থেকে আল্লাহপাকের ইবাদতের প্রতিও যেন দৃষ্টি থাকে। আমাদের চিন্তা-চেতনায় যে বিষয়টি জাগ্রত রাখা উচিত তা হলো, নেকি ও তাকওয়াকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলন করা, আর এটাই আমাদের আসল উদ্দেশ্য। রমজানের রোজা আর ঈদ আমাদের এ শিক্ষাই দেয়। দুটিই আমাদের আনুগত্যের শিক্ষা দেয়।
আমরা যখন পুরোপুরি স্থায়ীভাবে আমাদের গরিব ভাইদের অভাব দূরীকরণের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব, তখনই এটা হবে আমাদের প্রকৃত ঈদ উদযাপন। তাই যাদের সামর্থ্য আছে, তারা যেন গরিবদের স্থায়ী খুশির উপকরণের ব্যবস্থা করার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। বস্তুত ঈদের আনন্দ তখনই সর্বজনীন রূপলাভ করবে, যখন সমাজ ও দেশের সবাই একত্রে আনন্দের ভাগী হবে। আমাদের সন্তানদেরও ঈদের এ মাহেন্দ্রক্ষণে গরিবদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের শিক্ষা দিতে হবে। ঈদের যে উপহার তাদের দেওয়া হয়, তা থেকে যেন তারা একটা অংশ গরিবদের জন্য পৃথক করে নেয়। তারা যেন শুধু নিজেদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতিই খেয়াল না রাখে, কেবল নিজেরাই যেন ভালো খাবার না খায়, গরিব-অসহায় যারা রয়েছে, তাদের প্রতিও যেন খেয়াল রাখে। এ শিক্ষা আমাদের প্রত্যেক অভিভাবককে দিতে হবে তাদের সন্তানদের।
ঈদ যেহেতু কৃতজ্ঞতারই অপর নাম, তাই আমরা যদি ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাই, আল্লাহর কৃতজ্ঞতার ক্ষেত্রে সাহাবিরা কতই না উন্নতমানের ছিলেন। হজরত আব্দুর রহমান বিন আউফ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ করেন, আর তার ব্যবসা এত লাভজনক প্রমাণিত হয় যে, তিনি নিজেই বলতেন, আমি যে বস্তুতেই হাত দিতাম, আল্লাহতায়ালা তাতে এত বরকত রেখে দিতেন, যা ছিল কল্পনাতীত। তাকে আল্লাহতায়ালা অশেষ ধনভান্ডার দিয়েছেন, কিন্তু সে সম্পদ পাওয়ার পরও তার আচরণ কেমন ছিল? একদিন তিনি রোজা রেখেছিলেন। ইফতারির সময় যখন তার জন্য খাবার দেওয়া হয়, তখন সেখানে বিভিন্ন ধরনের খাবার দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন, আর ইসলামের প্রথম যুগের কথা স্মরণ করেন, যখন দিনের পর দিন মানুষকে অনাহারে কাটাতে হতো। তখন তার নিজের অবস্থাও তেমনই ছিল। সেসব সাহাবির কথা তার স্মরণ হয়। যখন যুদ্ধের ময়দানে তারা শহিদ হতেন, তখন তাদের জন্য পর্যাপ্ত কাফনও ছিল না। আর যে চাদর ছিল তা এত ছোট যে মাথা ঢাকলে পায়ে কোনো সতর থাকত না আর পা ঢাকলে মাথা খোলা পড়ে থাকত।
সাহাবিদের দৃষ্টান্ত ছিল এমনই। এখন আমাদের মাঝে কজন এমন আছি, যারা স্বাচ্ছন্দ্য আসার পর নিজেদের আগের সময়কে এভাবে সচেতনতার সঙ্গে স্মরণ করি? কজন আছি যারা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার চেতনা নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য লাভের পর সত্যিকার অর্থে তার ইবাদতের প্রতি মনোযোগ দেই এবং আগের চেয়ে বেশি মনোযোগ নিবদ্ধ করি? যদি জীবনমান উন্নত হওয়া, আর্থিক সচ্ছলতা আমাদের আল্লাহর প্রকৃত ইবাদতকারী বান্দায় পরিণত না করে, তাহলে আমাদের এই ঈদ উদযাপনের কোনো মূল্য নেই।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একদিকে যেমন ইসলামি ঐতিহ্যের জয়গান গেয়েছেন, অপরদিকে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববোধ বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। আবার ঈদের আনন্দকে সর্বজনীন হিসাবে তুলে ধরার জন্য লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় তিনি তার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন এভাবে-‘শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো/কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো/বরষের পরে আসিলে ঈদ!/ভূখারির দ্বারে সওগাত বইয়ে রিজওয়ানের/কন্টক-বনে আশ্বাস এনে গুলবাগের।’
তিনি ইসলামি সাম্যবাদী চেতনাকে সর্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তার বিভিন্ন কবিতায়। তার ‘নতুন চাঁদ’ কবিতায় বিষয়টি এভাবে ব্যক্ত করেছেন-‘সাম্যের রাহে আল্লাহের/মুয়াজ্জিনেরা ডাকিবে ফের.../রবে না ধর্ম জাতির ভেদ/রবে না আত্মকলহ ক্লেদ।’ এরপর ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’
ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে আমাদের মাঝ থেকে সবরকম অশুভ চিন্তা দূর হয়ে যাক। সবার মাঝে ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন রচিত হোক। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
মাহমুদ আহমদ : ইসলামি গবেষক
masumon83@yahoo.com