
প্রিন্ট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২৪ এএম
ন্যাটোতে বাড়ছে তুরস্কের প্রভাব

ড. সিনেম চেঙ্গিজ
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
তুরস্কের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশটি ১ জুলাই ন্যাটো অ্যালাইড রিঅ্যাকশন ফোর্স অ্যামফিবিয়াস টাস্কফোর্স কমান্ড এবং ল্যান্ডিং ফোর্স কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছে। ন্যাটোর মধ্যে এটি তুরস্কের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ একটি অর্জন। বছরব্যাপী এ দায়িত্বে থাকার সময় তুরস্ক ন্যাটোর সম্মিলিত প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদার করার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম তদারকি করবে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ নেতৃত্ব ন্যাটোর কার্যক্রম এবং সামরিক জোটটির প্রতিরক্ষা কাঠামোতে তার অবদানের স্বীকৃতি।
শুরু থেকেই ন্যাটোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক লেনদেনভিত্তিক। আঙ্কারা প্রথমে সদস্যপদ চেয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তবে ১৯৫০ সালে কেবল ‘সহযোগী মর্যাদা’র প্রস্তাব করা হয়। তবে কোরিয়া যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি লড়াই করার জন্য হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর আগ পর্যন্ত ন্যাটোতে শক্তিশালী সমর্থন পায়নি তুরস্ক। ১৯৫১ সালের মে মাসে তুরস্কের সদস্যপদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব দেয়। এর পরপরই ন্যাটো একে সমর্থন করে, ১৯৫২ সালে সদস্য হয়ে যায়। ন্যাটোর অংশ হওয়াটাকে তুরস্কে একটি যৌক্তিক পররাষ্ট্রনীতি হিসাবে দেখা হয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত হুমকির বিরুদ্ধে তুরস্কের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল ন্যাটোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ন্যাটোসদস্য হিসাবে তুরস্ক জাতীয় নিরাপত্তা পরিচিতি লাভ করে, ইউরোপিয়ান প্রতিরক্ষায় তার বক্তব্য দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। তাছাড়া পাশ্চাত্যের মিত্র হিসাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগও পায়। এর বিনিময়ে তুরস্ক জোটের দক্ষিণ এলাকা সুরক্ষার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে, ভূমধ্যসাগর এবং মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে কৌশলগত বাফার জোন হিসাবে কাজ করে। সোভিয়েত প্রভাব মোকাবিলায় ন্যাটোর কৌশলে তুরস্কের সহযোগিতা ছিল অত্যাবশ্যক।
‘আয়রন কার্টেনের’ প্রতীকী পতন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের ফলে মনে হচ্ছিল ন্যাটো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, পাশ্চাত্যের মিত্রদের কাছে তুরস্কের গুরুত্বও কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বর্তমানে রাশিয়া তাৎপর্যপূর্ণ খেলোয়াড় হিসাবে বহাল রয়েছে। তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্কে অস্বস্তি থাকলেও মস্কোর সঙ্গে আঙ্কারার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক পাশ্চাত্যের মিত্রদের কাছে তুরস্কের কৌশলগত মিত্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। অবশ্য, তুরস্কের নীতিমালা সবসময় ন্যাটো এবং ইইউর অংশীদারদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বেলায়। ইতিহাসের অন্যতম সবচেয়ে বেশি সময় স্থায়ী সামরিক জোট হলেও বর্তমানে ন্যাটো বৈশ্বিক নিরাপত্তার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ সমস্যায় পড়েছে। এর ঐক্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে কয়েকটি সদস্য দেশের দুর্বল সামরিক শক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপের বদলে প্যাসিফিকের দিকে নজর দেওয়ার বিষয়গুলোর কথা বলা যায়। হুমকিগুলোকে বিবেচনার ব্যাপারেও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ভিন্ন।
যুক্তরাষ্ট্রের পর ন্যাটোতে তুরস্কই দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক বাহিনীর অধিকারী। ন্যাটোর স্থাপনার দিক থেকেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব স্থাপনা এ অঞ্চলে ন্যাটোকে সময়োচিত জবাব দেওয়ার সক্ষমতার আলোকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ন্যাটো মিশনগুলোয় সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা পাঁচটি দেশের অন্যতম হলো তুরস্ক। তারা আফগানিস্তান ও কসোভোতে ন্যাটোর অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ন্যাটোর দক্ষিণদিক, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, কৃষ্ণসাগর এবং বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও ভূমিকা রাখছে। অবশ্য তুরস্কের রাজনীতি সবসময় ন্যাটো ও ইইউর অংশীদারদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বেলায় বিষয়টি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ন্যাটো ও ইইউ তাদের প্রভাব বাড়ানো, অর্থনীতির স্বার্থ জোরদার করা এবং ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিলেও তুরস্ক আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর বেশি জোর দেয়। আঙ্কারা মনে করে, তার পাশ্চাত্যের মিত্রদের নীতি অনুসরণ করার চেয়ে নিজের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং স্থিতিশীল অঞ্চল তার জন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হওয়া উচিত। এর ফলে তুরস্ক তার প্রতিবেশীদের জন্য নিজস্ব পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি অনুসরণ করছে, রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সতর্কভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে, ন্যাটো ও ইইউ অংশীদারদের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলার নীতি মেনে চলতে চাইছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর ওপর নির্ভরশীল হলে সমস্যাও যে হতে পারে, সে শিক্ষাও তুরস্ক পেয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় ন্যাটো মিত্রদের আঙ্কারার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বেশ ক্ষুব্ধ করেছিল তুরস্ককে। আবার ন্যাটোর মধ্যে তুরস্ক ও পাশ্চাত্যের মিত্ররা একই সমতলে নেই। আঙ্কারা প্রায়ই মনে করে, তার জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা উদ্বেগ অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মিত্রের কাছে গৌণ বিষয়ে পরিণত হয়। এর একটি উদাহরণ হলো তুরস্কের নিরাপত্তা উদ্বেগকে উপেক্ষা করে ওয়াশিংটন এখনো সিরিয়ার কুর্দিদের সহায়তা দিয়ে চলেছে। এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ-পূর্ব সময়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে ইউরোপিয়ান নীতির কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে।
এদিকে ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজকে দূরে সরিয়ে নিতে থাকায় তুরস্ক এখন তার প্রভাব বাড়ানোর জন্য ওই শূন্যতাকে ব্যবহার করতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইউরোপীয় মিত্রদের অবশ্যই তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতা করার পাশাপাশি তুরস্কের স্বকীয় পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির বিষয়টিও স্বীকার করে নিতে হবে।
এ অঞ্চলে ইসরাইলের সঙ্গে নতুন যে কোনো ধরনের সহযোগিতা রোধ করার জন্য ন্যাটোতে তার প্রভাব ব্যবহার করছে তুরস্ক। শোনা যাচ্ছে, আঙ্কারা জানিয়ে দিয়েছে, গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি না হওয়া পর্যন্ত সে তার এ নীতি অব্যাহত রাখবে। তুরস্ক ইতঃপূর্বে ন্যাটোর পর্যবেক্ষক হওয়ার ইসরাইলি চেষ্টা প্রতিরোধ করেছে।
যা হোক, ন্যাটো এখনো তুরস্কের কাছে গুরুত্বপূর্ণ জোট হিসাবেই রয়ে গেছে। আবার ন্যাটোর কাছেও তুরস্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ। কারণ তুরস্কের যে অনন্য ভূরাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে, তা অন্য কোনো দেশ পূরণ করতে পারবে না। অনেক দিক থেকেই তুরস্ক একইসঙ্গে ইউরোপিয়ান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। এই দ্বৈত ভূমিকা একদিকে সুযোগ এবং অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে পাশ্চাত্য ও রাশিয়ার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে। অবশ্য ন্যাটোর প্রতি তুরস্কের প্রতিশ্রুতি খুবই দৃঢ়। আর এর ফলেই দেশটি ২০২৬ সালে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করতে যাচ্ছে।
আরব নিউজ থেকে অনুবাদ : মোহাম্মদ হাসান শরীফ
ড. সিনেম চেঙ্গিজ : তুর্কি রাজনীতি বিশ্লেষক