তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য ইসলামফোবিয়ার প্রকাশ

আমিরুল মোমেনীন মানিক
প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67d9dd33ec387.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ড ভারত সফরকালে সোমবার এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি স্পর্শকাতর অনেক বিষয়ে কথা বলেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, বিশ্বজুড়ে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসকে পরাজিত করার দিকে দৃষ্টি রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের এবং তাদের পরাজিত করতে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ইস্যুতে করা এক প্রশ্নের জবাবে এই গোয়েন্দাপ্রধান বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিষ্পেষণ, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন দুর্ভাগ্যজনক। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার প্রশাসন উদ্বিগ্ন। লক্ষণীয়, এখানে তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর কথা বললেন; কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা বললেন না। অথচ জো বাইডেনের প্রশাসনের সময়কালে অনেকবার ভারতকে সতর্ক করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতে যে মুসলিম নিপীড়ন হচ্ছে, সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে জো বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন এসে ভারতে মুসলিম নিপীড়নের বিষয়টি তুলে ধরেননি।
মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান ভারতে এসে বললেন, দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তা বন্ধে ট্রাম্প প্রশাসন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাহলে তুলসী গ্যাবার্ড কোনদিকে ইঙ্গিত করছেন? বাংলাদেশের দিকেই তো তিনি ইঙ্গিতটা করছেন। এসব নিয়ে তিনি আরও অনেক কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনা সামনের দিকে আরও গতিশীল হবে; কিন্তু বিষয় হচ্ছে যে, এরই মধ্যে বাংলাদেশে নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। এতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন উদ্বেগ জানাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তুলসী গ্যাবার্ড। এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেছেন।
এটি হলো একটা প্রেক্ষাপট। তুলসী গ্যাবার্ড আরও যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো আসলে বিশ্বব্যাপী ইসলামফোবিয়াকেই উসকে দিচ্ছে। তিনি ইসলামি খেলাফতের আদর্শ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, কীভাবে উগ্রপন্থিরা এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো বিশ্বব্যাপী এমন একটি আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চায়, তা অবশ্যই আমাদের বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত। তুলসী গ্যাবার্ডের মতে, ইসলামপন্থি সন্ত্রাসের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের বৈশ্বিক প্রচেষ্টা একই আদর্শের এবং একই লক্ষ্যের-তাদের লক্ষ্য ইসলামি খেলাফতের শাসন প্রতিষ্ঠা। তারা যেটাকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে, তার বাইরে অন্যদের ক্ষেত্রে এটা স্পষ্টত অন্য যে কোনো ধর্মের মানুষকে প্রভাবিত করে। তিনি আরেকটি কথা বলেছেন-এমন আদর্শকে শনাক্ত করে তাকে পরাজিত করতে এবং মৌলবাদী ইসলামপন্থি সন্ত্রাসের উত্থানের ইতি ঘটাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে তুলসী গ্যাবার্ড প্রথমত, ইসলামফোবিয়াকে উসকে দিলেন। দ্বিতীয়ত, ইসলামপন্থার সঙ্গে উগ্রবাদীদের যুক্ত করলেন। ইসলামি রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নতুন বয়ান সামনে আনলেন।
আইএসএস, আল-কায়দাসহ বিশ্বব্যাপী যে চরমপন্থি সংগঠনগুলো আছে, তাদের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এখন ইসলামফোবিয়ার নতুন বয়ান উপস্থাপন করল ভারতের একটা মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিয়ে। এটা অবশ্যই উদ্বেগের। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক রাজনীতি যেমন যুক্ত রয়েছে, একইভাবে তাদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিও উপস্থাপিত হলো তুলসী গ্যাবার্ডের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম পালনকারী কোনো ব্যক্তি আর একজন উগ্রপন্থার সমর্থক কি এক হতে পারে? এটা কি এক পর্যায়ের? যিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাকে কি উগ্রবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা যায়? বাংলাদেশের কথাই বলি, এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আবার জাতীয়তাবাদী দলগুলো জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মধ্যপন্থি দলগুলো দেশপ্রেমের কথা বলে। ইসলামি রাজনীতি যারা করেন, তারা বলেন ইসলামি রাষ্ট্র গড়ে তুলবেন। সেটা কোন্ কাঠামোর মধ্যে? তারা বলেন, গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই। কিন্তু আপনি গণতান্ত্রিক কোনো সংগঠনকে কি বলতে পারেন, এরা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত? একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পিঠে কি আপনি তকমা এঁটে দিতে পারবেন যে, তিনি উগ্রবাদী সন্ত্রাসী? সুতরাং তুলসী গ্যাবার্ডের যে বয়ান, সেখানে কিন্তু স্পষ্টতই সব এক করে ফেলা হয়েছে। এখন সেই বয়ানটা যদি তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেন, যদিও এখানে তিনি স্পষ্ট করেননি অর্থাৎ কিছুটা কৌশলগত অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন; তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বাংলাদেশে নিপীড়ন হচ্ছে, এরকম বলেছেন এবং ট্রাম্প প্রশাসন এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঠিকই; কিন্তু ধর্মীয় উগ্রবাদ কিংবা সন্ত্রাসবাদ দমন করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের নানা ধরনের যে চেষ্টা আছে, সেই বিষয়টিকেও আবার সামনে এনেছেন।
তুরস্কের কথাই ধরুন। তুরস্কে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল যেমন রয়েছে, বামপন্থি দলও রয়েছে, মধ্যপন্থি দলও আছে। সেখানে ইসলামপন্থি বা ইসলামসমর্থিত ‘একে পার্টি’ ক্ষমতায় আছে। এখন যদি এই একে পার্টির সঙ্গে আল-কায়দা, আইএসএসের সম্পর্কের বয়ান জাতির সামনে বা বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করে ট্রাম্প প্রশাসন, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে হাস্যকর হবে। আমরা জানি, বৈশ্বিকভাবে যারা ইসলামকে হেয়প্রতিপন্ন করতে চায়, তারাই কিন্তু ইসলামের গায়ে সন্ত্রাসবাদের তকমা দেয়। যারা ইসলামি চেতনা বা ইসলামি আদর্শকে বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় তৈরি করতে চায়, তারা এই বয়ানটা হাজির করে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ যে কোনো ধর্মের নামে হতে পারে। সন্ত্রাসবাদ তো অন্যান্য ধর্মের ব্যক্তিরাও করছে; কিন্তু তাদের গায়ে এই তকমা কেন সেঁটে দেওয়া হচ্ছে না? হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান, যে যে জাতিগোষ্ঠী কিংবা ধর্মের মানুষ আছে, যে কোনো ধর্মের ভেতর থেকেই চরমপন্থার উদ্ভব হতে পারে। কিন্তু শুধু যদি মুসলমানদের ওপরই এই অভিযোগ দেওয়া হয় যে, তারা চরমপন্থার পথ অনুসরণ করছে, তাহলে সেটা কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত হবে। আমরা ভারতে যে মুসলিম নিপীড়ন দেখছি এবং সেখানে যে উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিকাশ, সেটাও তো এক ধরনের সন্ত্রাসবাদ। আবার আল-কায়দা, আইএসএস সারা বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে যে গণহত্যা চালাচ্ছে, সেটাও পরিত্যাজ্য বা অগ্রহণযোগ্য। সুতরাং, এখানে মার্কিন প্রশাসন যদি উগ্র সন্ত্রাসবাদ বা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ নিধনের নামে ইসলামফোবিয়াকে উসকে দেয় এবং ইসলামপন্থার নিন্দা করে, তাহলে সেটা হবে ভুল পলিসি।
আমিরুল মোমেনীন মানিক : সাংবাদিক