
প্রিন্ট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:১২ পিএম
পশ্চিম তীরকেও গ্রাস করতে চায় ইসরাইল

ইয়োসি মেকেলবার্গ
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন
ফিলিস্তিন-ইসরাইলকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘নো আদার ল্যান্ড’ এ বছরের অস্কারে সেরা ডকুমেন্টারির পুরস্কার পাওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্য আবারও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন দুর্দশার দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে, যা সাধারণত থাকে উপেক্ষিত। গত ১৮ মাসের বেশির ভাগ সময় মনোযোগ স্পষ্টতই গাজা যুদ্ধের দিকে ছিল, অন্তত ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষের প্রসঙ্গে। তা সত্ত্বেও এ সংঘর্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের গাজার ঘটনাবলি থেকে যদি একটি বিষয়ও শেখার থাকে, সেটা হলো, এ সংঘর্ষকে উপেক্ষা ও অবহেলা করার একটি মূল্য দিতে হয়েছে-খুব ভারি মূল্য। ইসরাইল-গাজা সীমান্তের উভয় পাশে চলমান চরম শত্রুতার পাশাপাশি ইসরাইল-লেবানন সীমান্তে এবং ইসরাইল দখলকৃত পশ্চিম তীরেও নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, বিশেষ করে এর উত্তরাংশে, এবং হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ইতোমধ্যে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে, যা কেবল উত্তেজনার ভয়ই নয়, বরং ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্তির ভয়ও বাড়াচ্ছে।
পশ্চিম তীরের বিষয়ে ইসরাইলের কৌশলটি গাজায় যুদ্ধ পরিচালনার পদ্ধতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। এটা অবশ্যই সামরিক কার্যক্রমের আকার ও তীব্রতার দিক থেকে নয়, বরং সেখানে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অত্যধিক শক্তি ব্যবহারের দিক থেকে, যখন ইসরাইল সাধারণ মানুষের জীবন ও মানবাধিকারের প্রতি অসংবেদনশীল। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত করার জন্য আরও বেশি উদগ্রীব হয়েছে, তাদের ফিরে আসার জন্য সময়সীমা নির্ধারণ না করেই। ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীরা ইতোমধ্যেই দখলকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের আরও জমি এবং নতুন উপনিবেশের তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে চরমপন্থিরা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধাতে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, হয় সহিংসতার মাধ্যমে অথবা সরকারের ও নেসেটে (ইসরাইলি পার্লামেন্ট) তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে, যারা আরও বেশি দখল প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য একদিন স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার আশা কমিয়ে দেওয়ার নীতি ও আইন প্রণয়ন করছে।
এটি অস্বীকার করা যায় না যে, ইসরাইল পশ্চিম তীরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে এবং তা হামাসের ৭ অক্টোবরের আক্রমণের অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এসব গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত নয়। তারা মূলত তরুণদের দ্বারা গঠিত, যারা দখলদারির অধীনে বসবাসের কারণে হতাশাগ্রস্ত, যারা নিজেদের (ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ) নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখে না এবং ফলস্বরূপ তারা উগ্রপন্থি হয়ে গেছে এবং সশস্ত্র প্রতিরোধের দিকে ঝুঁকেছে।
হামাসের সঙ্গে ১৫ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী খুব দ্রুত পশ্চিম তীরের দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করে এবং জেনিন, টুলকারেম ও টুবাস শহরে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে, যেখানে তাদের অনেক সামরিক কার্যক্রম শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘটে। এই শহরগুলো এলাকা ‘এ’-এর অন্তর্ভুক্ত এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও এর নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন থাকার কথা। এই বাহিনীই বছরের পর বছর ইসরাইলিদের অসংখ্য আক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করেছে। কিন্তু ইসরাইল সরকার এখন একটি অযৌক্তিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত, যা হলো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং এর নিরাপত্তা বাহিনীকে ধ্বংস করা। যে বিষয়টি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক তা হলো, যদিও অতীতে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম এ অঞ্চলে সীমিত পরিসরে ও সীমিত সময়ের জন্য ছিল, তবে এখন তা আর মনে হচ্ছে না, যা থেকে বোঝা যায় সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের বাইরেও ইসরাইলের অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে।
গত মাসে ইসরাইলি ট্যাঙ্কগুলো ২০০৩ সালের পর প্রথমবারের মতো পশ্চিম তীরে মোতায়েন করা হয়েছে, কারণ ইসরাইলি সেনাবাহিনী ঘোষণা করেছে, তারা উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর অংশে তাদের কার্যক্রম বাড়াচ্ছে। এদিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ স্বীকার করেছেন, তিনি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন অন্তত পরবর্তী এক বছর পশ্চিম তীরের শরণার্থী শিবিরে থাকতে, যেখানে তারা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং সম্প্রতি বিতাড়িত প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িতে ফিরে আসা থেকে বিরত রাখছে। জেনিন, টুলকারেম ও নূর শামসের তিনটি শরণার্থী শিবির থেকে বিতাড়িত ব্যক্তিদের চাপ পশ্চিম তীরের অন্য অঞ্চলে প্রয়োগ করছে, যেখানে তারা পালিয়ে যাচ্ছে। এটি এমন একসময়ে ঘটছে, যখন ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের মানবিক সাহায্য প্রদানকারী জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএকে সম্প্রতি ইসরাইল সরকার নিষিদ্ধ ও বয়কট করেছে এবং সংস্থাটি তীব্র অর্থ সংকটে ভুগছে।
যাদের ইসরাইল ও ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে সহিংস কিছুই করার নেই, তাদের বিতাড়িত করা একটি অবৈধ, নিষ্ঠুর ও অন্যায় কাজ। যদি এ প্রবণতা থামানো না হয়, তাহলে পশ্চিম তীরকে ইসরাইলের সঙ্গে কার্যত সংযুক্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরপর একটি তথাকথিত ‘আইনি’ সংযুক্তি ঘটবে। অল্প কিছুসংখ্যক ফিলিস্তিনিসহ বসতি স্থাপনকারীদের, যারা বর্তমান ইসরাইল সরকারের বড় অংশ, পশ্চিম তীরে বসবাস করানোই এর চূড়ান্ত লক্ষ্য।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর
ইয়োসি মেকেলবার্গ : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অফ তাসখন্দ, উজবেকিস্তান