
প্রিন্ট: ১৬ মার্চ ২০২৫, ০২:১৫ পিএম
‘সিস্টেমে’ আসুক পরিবহণ খাত

আসিফ রশীদ
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জনাব শেখ মইনউদ্দীনকে বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসাবে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, তাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয় সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে অত্যধিক ব্যয়ের বিষয়টিতে রাশ টানা, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা এবং রাজধানী ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যানজট কমিয়ে আনার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে প্রায় ২৫ বছর ধরে এ ধরনের কাজ করে আসছেন শেখ মইনউদ্দীন। তিনি ২০২৩ সাল থেকে ওই অঙ্গরাজ্যের পরিবহণ বিভাগের নিরাপত্তা ও পরিচালন বিভাগের প্রধান হিসাবে কর্মরত। গণপরিবহণ ব্যবস্থাপনায় উদ্ভাবনী ভূমিকা রেখেছেন। যেমন, লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে ‘ডায়নামিক লেন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ চালু করার নেতৃত্ব দেন তিনি, যা মহাসড়কের নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই শেখ মইনউদ্দীনের এ নিয়োগে আমরা আশাবাদী। এদেশের চরম বিশৃঙ্খল সড়ক ব্যবস্থাপনায় তিনি যদি শৃঙ্খলা আনতে পারেন, সেটা হবে এ সরকারের একটি বড় সাফল্য। এ পর্যন্ত সড়ক পরিবহণ খাতে বর্তমান সরকার কেন, কোনো সরকারই শৃঙ্খলা আনতে পারেনি।
সম্প্রতি রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মিটারবিহীন চলাচল ও ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু চালকদের ‘আন্দোলন’ তথা সড়ক অবরোধের মুখে সরকারকে পিছু হটতে হয়। আসলে এটি কোনো আন্দোলন নয়, অরাজকতা। ক’দিন আগে আমরা দেখেছি রাজধানীতে গণপরিবহণ সংকটের কারণে কর্মদিবসে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে। জানা যায়, কয়েকটি রুটে সরকার ই-টিকিটিং ও কাউন্টার ব্যবস্থা চালু করায় অনেক বাস রাস্তায় নামেনি। ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় নাকি পরিবহণ শ্রমিকরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন! ‘যেখানে সেখানে’ যাত্রী তোলার দাবিতে তারা সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় সড়ক অবরোধও করেছেন। অবশেষে পরিবহণ শ্রমিকদেরই ‘জয়’ হয়েছে; ব্যর্থ হয়েছে সরকারের উদ্যোগ। আমরা আগেও দেখেছি, সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের মনমতো না হলে তারা যাত্রীদের জিম্মি করে ভোগান্তিতে ফেলেছেন। গত সরকারের সড়ক পরিবহণমন্ত্রী রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরানোর ব্যাপারে বড় বড় কথা বললেও শেষ পর্যন্ত পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন। ফলে রাজধানীর সড়কে অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলা চরমে ওঠে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ওই সরকারের পতনের পর আশা করা হয়েছিল, সবকিছুর মতো এক্ষেত্রেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তা আসেনি। বরং এখন রাজধানীর অলিগলি ছাপিয়ে প্রধান সড়কগুলোয়, এমনকি ফ্লাইওভারেও কিছুসংখ্যক ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে, যার ফলে বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে। পরিবহণ সেক্টরে নতুন করে চাঁদাবাজির অভিযোগও শোনা যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে এ সেক্টরটি যেভাবে চলছে, যে নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা কোনো সভ্য দেশের উদাহরণ হতে পারে না। অনেক অনিষ্টের মূলে রয়েছে দেশের পরিবহণ খাত। এরা মানুষ খুন করেও বিচার মানতে নারাজ! এদের আর এভাবে চলতে দেওয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারে কিছু একটা করার সময় এখনই। এ খাতকে একটা ‘সিস্টেমে’ আনতে হবে; যার যেমন খুশি, সেভাবে চলতে দেওয়া যাবে না।
২.
আমাদের ছাত্রজীবনে ঢাকা নগরী বেশ ছিমছাম ছিল। রিকশায় ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগত। সে সময় বিদেশ থেকে, বিশেষ করে পাশের কোনো দেশ থেকে কেউ ঢাকায় এলে মুগ্ধ হয়ে যেত। দেখতে পেত পরিচ্ছন্ন নগরী। রাস্তাগুলো প্রশস্ত। যানজট নেই। যান চলাচলে নেই বিশৃঙ্খলা। প্রায় প্রতিটি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা এবং তা মেনে চলছে সবাই। একসময় অটোরিকশার ভাড়া নেওয়া হতো মিটার অনুযায়ী।
সেই দৃশ্যপট বদলে গেছে। নগরীতে জনসংখ্যা বেড়েছে। কয়েকগুণ বেড়েছে যানবাহন। কিন্তু এসবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে নগরীর সম্প্রসারণ ঘটেনি। গড়ে ওঠেনি যথাযথ নগর ব্যবস্থাপনা। ভেঙে পড়েছে সব ‘সিস্টেম’। ফলে ঢাকা এখন এক বিশৃঙ্খল নগরী। প্রতিটি রাস্তায় যানজট। যত্রতত্র খানাখন্দ। রাস্তা খোঁড়া হয় যখন-তখন। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা দূরে থাক, ট্রাফিক পুলিশের হাতের সিগন্যালও কেউ মানতে চায় না। গণপরিবহণ নিয়ম মানে না। যে যেমন খুশি চলে, যেমন খুশি থামে, যাত্রী ওঠায়নামায়। ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রেও স্বেচ্ছাচারিতা। ওভারটেকিংয়ের জন্য এক বাস (আসলে মিনিবাস) আরেক বাসের গা ঘেঁষে চলে, যেন ক্রসকান্ট্রি রেস! এক বাস আরেক বাসকে ইচ্ছা করে আঘাত করতেও দ্বিধা করে না। তাই নগরীর মধ্যেও দুর্ঘটনার শিকার হয় মানুষ। একে তো যানজট, তার ওপর গণপরিবহণের অভাব; ফলে মানুষের জন্য অফিস-আদালতে বা প্রয়োজনীয় স্থানে যাতায়াত করা হয়ে দাঁড়ায় দুর্বিষহ।
আগে এ নগরীতে বড় বড় বাস চলত, যা বেশি যাত্রী বহন করতে পারত। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে মিনিবাস, যা রাস্তায় জায়গা দখল করে বড় বাসের সমানই; কিন্তু যাত্রী বহন করতে পারে না বেশি। শোনা যায়, কী এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নাকি পরিবহণ শ্রমিক-মালিকরা মিলে রাস্তা থেকে বড় বাস উঠিয়ে দিয়েছেন! এ নগরীতে যে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলে, সেগুলোর অবস্থাও অনেকটা বাসেরই মতো। বারবার ভাড়ার হার বাড়িয়েও কোনো অটোরিকশা চালককে মিটারে চলতে বাধ্য করা যায় না। তারাও চলে নিজেদের মর্জিমাফিক, যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করে নির্ধারিত ভাড়ার কয়েকগুণ। সবকিছু মিলিয়ে অনেকের কাছেই এ নগরীকে মনে হয় নরকতুল্য। একান্তই চাকরি বা ব্যবসায়িক প্রয়োজন না থাকলে যে এখানে এত মানুষ বসবাস করত না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথিবীর আর কোনো রাজধানী শহরের সড়ক ও গণপরিবহণ ব্যবস্থায় এত নৈরাজ্য, এত বিশৃঙ্খলা রয়েছে কিনা জানি না।
৩.
ঢাকা নগরীর সড়কে বিশৃঙ্খলার একটি কারণ নিশ্চয়ই অত্যধিক যানবাহন। তবে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ এবং সঠিকভাবে তা মনিটর করা হলে সড়কে অনেকটাই শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে মনে করি। তাতে বেশি যানবাহন থাকার পরও যানজট সহনীয় হয়ে উঠতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সড়কে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী প্রধান দুই ধরনের যানবাহন হলো বাস ও মোটরসাইকেল। বাসগুলো স্টপেজ বা কাউন্টারের তোয়াক্কা না করে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করায়। ফলে সৃষ্টি হয় যানজট। এটি বন্ধ করতে হবে কঠোরভাবে। বাসগুলোকে স্টপেজের ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়াতে বাধ্য করতে হবে। অন্য কোথাও থামতে দেওয়া যাবে না। আর মোটরসাইকেলের বেপরোয়া চলাচল বন্ধ করতে তাদের সড়কের একপাশ দিয়ে চলাচলে বাধ্য করতে হবে।
রাজধানীর যানজট নিরসনে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বলা হয় প্রায়ই। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমানো যাবে তখনই, যখন রাস্তায় পর্যাপ্তসংখ্যক মানসম্পন্ন গণপরিবহণের ব্যবস্থা থাকবে। ঢাকায় একটি রুটে মেট্রোরেল চালু হওয়ায় সেই রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের দুর্ভোগ অনেকটা লাঘব হয়েছে সত্য; তবে প্রমাণ হয়েছে, যাত্রীর তুলনায় মেট্রোরেল বা এর বগির সংখ্যা অপ্রতুল। রাজধানীতে মেট্রোরেলের অন্য যে রুটের কাজ এখন চলছে, সেই রুটে চলাচলকারী নগরবাসীর দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। এ নির্মাণকাজ যেন কোনোভাবেই নির্ধারিত সময় অতিক্রম না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এখন রমজান মাস। ইফতারের কয়েক ঘণ্টা আগে রাজধানীর রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ রূপ নেয়। বহু মানুষকে পথেই সারতে হয় ইফতার। এ কথা মাথায় রেখে রমজানে সড়ক ব্যবস্থাপনায় বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
৪.
অধিকাংশ দেশে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলের চেয়ে প্রান্ত থেকেই কাজের জন্য আসা মানুষের সংখ্যা বেশি। তারা সন্ধ্যার মধ্যে কাজ শেষ করে দূরপাল্লার যানবাহনে যার যার আবাসস্থলে ফিরে যায়। এতে অফিস সময়ের বাইরে নগরীতে মানুষ ও যানবাহনের চাপ কম থাকে। আমাদের দেশেও মানুষ যাতে নগরীর ভেতর দিনে দিনে কাজ সেরে যে যার দূরবর্তী গন্তব্যে ফিরে যেতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে নগরীর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। এটি ঢাকার ওপর চাপ কমাতে সহায়ক হবে। তবে কায়েমি গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার যে প্রবণতা দেশে চলে আসছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, সেটা ভেঙে দিতে না পারলে যে পরিকল্পনাই নেওয়া হোক, তা কখনো জনবান্ধব হয়ে উঠবে না।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে পরিবহণ সেক্টর মূলত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে সরকার এ সেক্টরকে নিয়ম বা সিস্টেমের মধ্যে আনার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। এ থেকেই সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা। তাই পরিবহণ সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহির একটা ব্যাপার থাকে, যেটা আমাদের দেশে নেই। আর নেই বলেই সব ক্ষেত্রে কায়েমি গোষ্ঠী তার স্বার্থরক্ষায় তৎপর থাকে। এতে জনস্বার্থ হয় উপেক্ষিত। এখানে ট্রেনের টিকিট কাটার মতো সামান্য বিষয়েও সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। টিকিট হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু সিটটি পাওয়া যায় না কাঙ্ক্ষিত স্থানে। আপনি হয়তো এসি বার্থ বা চেয়ারে যেতে চাইছেন; কিন্তু বলা হবে-টিকিট নেই, সব বুক্ড হয়ে গেছে। সবকিছুই যেন ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত! আসলে সব ক্ষেত্রেই চলে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন। সাধারণ মানুষ এখানে অপাঙ্ক্তেয়।
এই দুর্বৃত্তায়নের বলয় শক্ত হাতে ভেঙে দিতে হবে। দেশে এখন একটা পরিবর্তন এসেছে। ক্ষমতায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার নানা কারণে জনদুর্ভোগ প্রশমনে সক্ষম হচ্ছে না। অন্তত সড়ক পরিবহণ খাতে দুর্ভোগ কমাতে পারলে জনগণ তাদের মনে রাখবে। শুরুটা তারা করে গেলে আগামীতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা সেটা এগিয়ে নেবেন।
আসিফ রশীদ : যুগান্তরের উপসম্পাদক
arbangladesh@gmail.com