নতুনের মৌলিকত্ব ও পুরোনোর অভিজ্ঞতা

শায়রুল কবির খান
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নতুনের মধ্যে ‘মৌলিকত্ব’ ও পুরোনোতে ‘গুণগত পরিবর্তন’ অপরিহার্য, তবেই সমাজে-রাষ্ট্রে তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। আর নতুনের মধ্যে মৌলিকত্ব, পুরোনোতে গুণগত পরিবর্তন না থাকলে সাময়িক আলোচনার সূত্রপাত কিংবা উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয় বটে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মোহভঙ্গ হয়।
মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বাধীনতার উষালগ্নেই নাগরিকদের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের বিপরীতে অবস্থানরত জনশক্তি ও জনআকাঙ্ক্ষা হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিল।
এমন অবস্থায় শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (বীরউত্তম) রাষ্ট্রের নেতৃত্বে এসে জনআকাঙ্ক্ষাভিত্তিক দুটি সঠিক পদক্ষেপ নিলেন। একটি সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ আর অন্যটি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। একটি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের চালিকাশক্তি। অন্যটি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতি শ্রদ্ধা। তিনি কতটা নিখুঁত আর্কিটেক্ট, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ডে নানা ভাষা-গোষ্ঠীর নাগরিকদের বিশ্বদরবারে জাতি রাষ্ট্রের পরিচয় দিলেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ নামক রাজনৈতিক দর্শনের মাধ্যমে।
ইসলাম ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র না করে সব ধর্মের নাগরিকের সমমর্যাদা রেখে একটি ক্যানভাসে আঁকলেন। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর ভিত অনেক মজবুত ও কঠিন। তার বিপরীতে আগে ও পরে কেউ এমন জায়গা নিতে পারেননি, আর ভবিষ্যতেও পারার সম্ভাবনা নেই। এর একটি যৌক্তিক কারণও আছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে দুটি ইস্যু স্থায়ী জায়গা নিয়েছে। প্রথমটি ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ। দ্বিতীয়টি, শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর হাত ধরে তার নীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের পরিচয় সত্তা, যা ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’।
শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম সঠিকভাবে বুঝেছিলেন, এ অঞ্চলের নাগরিকদের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার বা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার জায়গাটা কোথায়। তার ওপর দীর্ঘ নিবিড় চর্চা ও বিচক্ষণতায় সততার সঙ্গে রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন তিনি। তাই স্বল্প সময়ে অর্থাৎ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে রাষ্ট্রপতি হয়ে চার বছরের কিছু বেশি সময়ে শিশু একাডেমি থেকে শুরু করে যুব কমপ্লেক্স ও প্রবীণ নিবাস করার মধ্য দিয়ে সর্বজনীন হয়ে উঠেছিলেন।
অর্থনৈতিক মৌলিক মডেল দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি শিল্প আর প্রবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছিলেন, যার বিপরীতে আজ ৫০ বছরের বেশি সময়ে বাংলাদেশে এখনো কেউ সমতুল্য কিছু করতে পারেননি। কতটা দূরদর্শিতার রণকৌশলী হলে একজন মেজর হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। প্রথম ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’-এর অধিনায়ক তিনি। প্রথম ৫০০ বর্গমাইল এলাকা স্বাধীন ঘোষণা করে বেসরকারি প্রশাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাও তার বড় অবদান। স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম শহিদ সৈনিকদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ কুমিল্লা সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীনতা ও একুশে পদক এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপন, এগুলো কি গুণগত, নাকি মৌলিক? এর বিপরীতে নতুন কী কী প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর কর্মকাণ্ড স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়।
এবার যে লক্ষ্য রেখে এ লেখা, তার মধ্যে মনোযোগ দিতে চাই-গত প্রায় ১৭টি বছর এ দেশে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ নাগরিক চরম নিপীড়ন-নির্যাতন-হামলা, লাখ লাখ মামলা, গুম-গণহত্যার শিকার হয়েছেন। ২০২৪ জুলাই, ৫ আগস্টে ব্যাপক সংখ্যায় নির্যাতিত ছাত্র-জনগণের নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থান হয়। নতুন প্রজন্ম নিজের নিকট অভিজ্ঞতায় জেনেছে, রাজনীতিকে অপব্যবহার করে কীভাবে আওয়ামী লীগ রাজনীতিকে নিছক ক্ষমতা ও বিত্ত লাভের উপায় ভেবেছিল। তাই নতুনরা ওয়েবসাইট তৈরি করে ইস্যুভিত্তিক ও রাজনৈতিক মতামত নির্বিশেষে প্রধান বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে একটি ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলে। সেই অরাজনৈতিক নানা বর্ণের প্ল্যাটফর্ম থেকে উদ্ভূত আন্দোলনই অনেক মূল্যের বিনিময়ে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে স্বৈরাচার উৎখাত করে বিশাল এক প্রাথমিক বিজয় অর্জন হয়েছে। এ প্রাথমিক বিজয়ই ‘রাষ্ট্রক্ষমতা’ অর্থাৎ স্বৈরাচারের বিদায়ের পর কে সেখানে বসবে, সে প্রশ্ন তুলে ধরেছে জাতির সামনে। এ প্রশ্ন কি অতি গুরুত্বপূর্ণ? আন্দোলনের সমন্বয়করা এবার রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ ঘোষণা করলেন। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে আহ্বায়ক হয়েছেন। অন্য ছাত্রনেতারা ভিন্ন ভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
তাদের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশদরদি তারেক রহমান অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এ সময়ে এসে আবারও তাই প্রমাণ করেছে। এত আত্মত্যাগের পর যদি কোনো নতুন সাম্রাজ্যবাদ বা মৌলবাদের আদর্শপুষ্ট ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক শক্তি বা আরও বৈষম্যবাদী কোনো গোষ্ঠী এসে শূন্যস্থানে বসে, তাহলে ছাত্রসমাজ ও জনগণের এ গৌরবময় আন্দোলন ব্যর্থ হবে না? সেটিও নিশ্চয়ই ছাত্র-জনতা চাইবেন না?
তাই রাজনৈতিক প্রশ্নটিকে এখন এ মুহূর্তে ছাত্রদের তৈরি করা রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা বিবেচনায় না নিয়ে উপায় নেই। এখন পর্যন্ত দাবিগুলো তাদের ভাষায় ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’কে তাড়িয়ে ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা’র বিলোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ; কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিলোপ বা যে কোনো উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, মৌলবাদী ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা রাষ্ট্রধর্ম অথবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিপীড়ন ইত্যাদি প্রবণতায় রয়েছে মৌলিক বিরোধ।
কিন্তু ইতোমধ্যেই এসব প্রবণতা দেশের ভেতরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে; এ ব্যাপারে কি তারা সচেতন? যদি এ ব্যাপারে তারা সচেতন হন, তাহলে তাদের দলের উচিত হবে এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে দলের নীতি প্রতিষ্ঠা করা। তা করার জন্য নতুনের মধ্যে ‘মৌলিকত্ব’ দরকার হবে। তাদের রাজনীতিতে কী ধরনের মৌলিকত্ব আছে, নাগরিকরা নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করেই তা গ্রহণ করবেন।
বেশিরভাগ তরুণই তাই যে যে দলই অতীতে করুন না কেন বা যে দলের প্রতি যে আশায়ই সমবেত হন না কেন, বাস্তবে সমস্যা সমাধানের একটি সুনির্দিষ্ট রূপকল্প কিন্তু তাদের কাছ থাকতে হবে। একটি বৈষম্যহীন সমাজে প্রত্যেকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার জন্য সমাজের কী ধরনের মৌলিক রূপান্তরের প্রয়োজন হবে, তা নিয়ে তরুণদের ও প্রতিযোগী দলগুলোর ধারণা স্পষ্ট হতে হবে।
লক্ষণীয় বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আলোচিত উজ্জীবিত রাজনৈতিক দলের নাম ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক নীতির ওপর ভিত্তি করে জাসদ। আজ তাদের সংগঠনের পরিস্থিতি কী? আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে কত বড় বড় নেতা রাজনৈতিক দল তৈরি করলেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বিকল্প রাজনীতির কথা বলে বিকল্পধারা নামে দল করলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৯ বছর রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়ে স্বৈরাচারের তকমা নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে বিদায় নিলেন। তার দল একই নামে কয়টা ভাগ হয়েছে, বলা মুশকিল।
বাম ভাবধারা ও ইসলামি ভাবধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কথা আর নাই বললাম। জাঁকজমকভাবে পাঁচ তারকা হোটেলে জন্ম নেওয়া ইনসাফ পার্টি কোথায়? বিশেষ করে আরও বলার প্রয়োজন, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উচ্চাভিলাষী ভাবনায় আমি-ডামি নির্বাচনের নামে রাতারাতি নতুন দল ও নিবন্ধন পাওয়াদের কী পরিণতি হয়েছে! এগুলো নাগরিকদের সামনে স্পষ্ট দিবালোকের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে। এ বিষয়গুলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সম্ভাবনাময় ছাত্রনেতারা আশু উপলব্ধিতে এসে দীর্ঘমেয়াদি বিষয়ে যদি রূপান্তরিত করতে চান, তাহলে আশা করি, মনোযোগ দেবেন।
তাতে তাদের ও দলের এবং দেশের কল্যাণ হবে।
শায়রুল কবির খান : রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী