হালফিল বয়ান
শান্তির রমজানে বাজারে কেন অশান্তি

ড. মাহফুজ পারভেজ
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রহমত, বরকত, মাগফিরাতের মাস রমজানকে অধীর আগ্রহে ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে স্বাগত জানিয়েছে সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান নারী ও পুরুষ। পবিত্র রমজানের চাঁদ দেখে দোয়া করেছেন : ‘হে আল্লাহ! আমাকে শান্তিময় রমজান দান করুন। রমজানকে আমার জন্য শান্তিময় করুন। রমজানের শান্তিও আমার জন্য কবুল করুন’ (আল্লাহুম্মা সাল্লিমনি লিরমাদান, ওয়া সাল্লিম রামাদানা লি, ওয়া তাসলিমাহু মিন্নি মুতাক্বাব্বিলা)। রাসূলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় রমজানের চাঁদের অনুসন্ধান করতেন। এমনকি সাহাবিদের চাঁদ দেখতে বলতেন। রমজানের নতুন চাঁদ দেখলে প্রিয় নবি (সা.) কল্যাণ ও বরকতের দোয়া করতেন। মুসলমানরাও এমন দোয়া করে থাকেন।
শান্তি, কল্যাণ ও সৌভাগ্যের বার্তাবাহী রমজান মাস উপলক্ষ্যে বিশ্বের বহু মুসলিম প্রধান দেশে কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দ্রব্যসামগ্রীর দাম কমানো হয়েছে। সরকার, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও সমাজের পক্ষ থেকে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ শান্তিতে রোজা পালন ও অন্য আমল নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারেন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারেন।
কিন্তু রমজানের প্রাক্কালে বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে, শান্তির বিপরীতধর্মী অশান্তির বাস্তবতা। শুধু এ বছরই নয়, প্রতিবছরই রমজান, ঈদ বা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে চলে সাধারণ মানুষের পকেট কাটার মচ্ছব। মজুতদারি করে রোজার আগে বাড়িয়ে দেওয়া হয় দ্রব্যমূল্য। সৃষ্টি করা হয় কৃত্রিম সংকট। রোজাদার মানুষকে ঠেলে দেওয়া হয় অগ্নিময় বাজারের নরককুণ্ডে। রমজানে শান্তির আবহে মানুষ আক্রান্ত হয় অশান্তি ও অসুবিধার বাস্তবতায়। এ বছরও যার ব্যতিক্রম হয়নি অসাধু গোষ্ঠীর কারসাজির কারণে।
যদিও বিগত সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন খাতে অসাধু সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে বলেই আশান্বিত ছিল সাধারণ মানুষ, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা বন্ধ হওয়া দূরে থাক, বরং সাময়িক আড়ালে থাকার পর আবারও তারা তৎপর হয়ে উঠছে। রোজায় অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমজনতার বিরুদ্ধে। ওয়াকিবহাল মহল, যারা নিত্যবাজার করেন, তারা দেখতে পাচ্ছেন, রমজান সামনে রেখে বাজারে সয়াবিন তেল নিয়ে ফের তেলেসমাতি শুরু হয়েছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক এ জন্য যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ভোজ্যতেল আমদানি করা হলেও বাজারে কেন এর প্রভাব নেই? যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ থেকে ৭টি কোম্পানি তেলের বাজার ঘিরে কারসাজি অব্যাহত রেখেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো জোটবদ্ধ হয়ে গত কয়েক মাস ধরে সরবরাহ কমিয়ে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে।
শুধু বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারশূন্য হয়ে পড়ছে বা এর মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, এমন নয়। দাম বাড়ানো হয়েছে মুরগি, ডিম, মসলা ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যেরও। রমজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারী কতিপয় অসাধু প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের জিম্মি করে ফেলেছে। মূল সরবরাহকারীদের এহেন অপকর্মের ফলে খুচরা বাজারেও পড়েছে দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির কোপ এবং সংকট। এসব দাম বাড়ানো ও সংকট সৃষ্টি যে উদ্দেশ্যমূলক ও কৃত্রিম তার প্রমাণ স্পষ্ট। কারণ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসের চাহিদা ৩ লাখ টন। দেশে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪৮ টন। এছাড়া দেশে উৎপাদিত হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টন এবং আমদানি পর্যায়ে পাইপলাইনে রয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬৫ টন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য নিম্নমুখী। এ তথ্য থেকেই বোঝা যায়, দেশে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কোনো প্রকৃত কারণ নেই। অতএব, ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের মূলে রয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠানের কারসাজি। কারা কোন পর্যায়ে কারসাজি করছে, তা চিহ্নিত করে দায়ীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা না হলে এদের অত্যাচার বাড়তেই থাকবে এবং জনশান্তি বিপন্ন হতেই থাকবে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, অতীতের স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ফ্যাসিবাদী সরকারের মদদে ও আঁতাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যে অপকর্ম করেছে, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতিতেও তারা বহাল তবিয়তে সেই একই অপকর্মই করে চলেছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও অসাধু ব্যবসায়ীরা রমজান শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই ছোলা, ভোজ্যতেল, চিনি ইত্যাদি পণ্যের দাম বাড়ানো শুরু করেছে। অতীতে আমরা লক্ষ করেছি, রমজান মাসে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে, সেসব পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়ার পরও ভোক্তারা এর সুফল পায়নি। এবারও তেমনটি ঘটেছে।
সবকিছু জানার পরও কর্তৃপক্ষ বাজারের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে সমর্থ হয়নি। বিগত সরকারের আমলে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি রোধে কর্তৃপক্ষ অনেক আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশা। কোনো স্বার্থান্বেষী মহল যাতে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে, সেজন্য কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে সরিষার ভেতরের ভূত তথা পতিত সরকারের সঙ্গে দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যবসায়ীদের দমনে নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ।
শান্তির রমজানে বাজারে অশান্তি ও মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ীদের গণশত্রুরূপে চিহ্নিত করাও দরকার। আইনের পাশাপাশি সামাজিকভাবে এদের বর্জন করা জরুরি। এরাই প্রতিবছর রমজান মাসে সারা দেশে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায়। বিশেষ করে রোজার সময়ে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এর পেছনে ব্যবসায়িক লাভের মনোবৃত্তির মতোই রয়েছে তাদের মধ্যে বিরাজমান অনৈতিক প্রবণতা। এদের জন্যই সম্ভব হয় মজুতদারি এবং সিন্ডিকেটভিত্তিক লুটপাট। রমজানের অপেক্ষায় এরা সারা বছরই কিছু পণ্যের মজুত রাখে। রমজান মাসের শুরুতে তারা এসব পণ্য বাজারে কম পরিমাণে সরবরাহ করে এবং চাহিদা বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ পায়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড অনৈতিক এবং ভোক্তা স্বার্থের প্রতি অবহেলা তো বটেই, আইনের দিক থেকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বড় বড় ব্যবসায়ীর অনুকরণে রমজান মাসে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে টাকা কামানোর ধান্ধায় লিপ্ত হয়। তারাও সাধ্যমতো নিত্যপণ্য মজুত করে ও সরবরাহ কমিয়ে রাখে। সারা বছর ধরেই তারা হাঙরের মতো অপেক্ষা করে রমজান মাসে অতিরিক্ত মুনাফা লাভের জন্য। এতে ব্যবসায়ীরা সাময়িক লাভ করতে পারলেও সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর জাগতিক লাভের লোভাতুর মানসিকতার কারণে তাদের নীতি, নৈতিকতা ও ধর্মীয় অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এতকিছুর পরও প্রতিবছরই রমজানের আগে মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ী বিভিন্ন নিয়মনীতি উপেক্ষা করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করতেই থাকেন। কঠোর আইন ও পর্যাপ্ত নজরদারি ছাড়া ব্যবসায়ীদের এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড থামানো সম্ভব নয়। কিন্তু সরকারি এবং স্থানীয় প্রশাসনের মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে যদি অভাব থাকে কিংবা কর্তৃপক্ষই যদি অর্থের বিনিময়ে দুর্নীতিবাজ হয়ে নজরদারিতে শৈথিল্য দেখায়, তাহলে বাজার দুর্বৃত্তদের রোধ করবে কে?
দেশের রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলাগত শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনার জন্য সমাজ ও মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে অন্যবিধ স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না। বরং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাজনৈতিক, সামাজিক, আইনশৃঙ্খলাগত অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে। এজন্য বিশ্বের সব দেশেই বাজারব্যবস্থাকে স্থিতিশীল ও শান্ত রাখা হয়। বাংলাদেশের মতো এতো নিয়ন্ত্রণহীন বাজার সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সকালের দাম বিকালে দ্বিগুণ হওয়া অথবা কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ ইত্যাদি পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রেও আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে আকছার ঘটলেও সারা বিশ্বেই তা বিরল ঘটনা।
এসবই হতে পারছে অসাধু ব্যবসায়ী আর বাজার সিন্ডিকেটের কারণে, যার সঙ্গে রয়েছে সরকারের কার্যকর বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা। আর্থিক দুর্নীতির কারণে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে পরিস্থিতির অবনতি হতে বাধ্য। সরকারি সংস্থাগুলো বাজারে দ্রব্য সরবরাহে ও মূল্যে স্বচ্ছতার বিষয়ে যথাযথ নজরদারি চালালে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করতে পারত না। তাছাড়া মজুতদারি ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের প্রয়োগ ও শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলেও ভয়ে অপরাধীরা কিছুটা হলে কোণঠাসা হতো। বাস্তবে এসব হচ্ছে না বলেই মজুতদারি এবং সিন্ডিকেটের দাপট চলছেই। বাজারে নিয়মিত অভিযানের মাধ্যমে সরকারি সংস্থা ও দুদক যদি সরব থাকে, তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বছরের পর বছর সবল ও আক্রমণাত্মক থেকে মানুষের দুর্ভোগের বাস্তব কারণ হওয়ার কথা নয়।
তদুপরি, বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য ভোক্তা ও গ্রাহকদের সচেতন হওয়া জরুরি। বিশেষ করে, রোজা বা অন্য যে কোনো সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভোক্তাদের প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসা দরকার। ভোক্তাদের অধিকার এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অভিযোগ জানানোর জন্য একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম গঠন করা যেতে পারে, যারা সরকারি সংস্থার কাজের গতি-প্রকৃতির ক্ষেত্রেও নজরদারি রাখবে। এটা অবশ্যই সত্য যে, রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির সমস্যা একাধিক কারণের ফল। যার সঙ্গে জড়িত আছে ব্যবসায়ী, সিন্ডিকেট, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিক ও চাঁদাবাজ মাফিয়া চক্র। ভোক্তা ও গ্রাহকরাও বাজারব্যবস্থার একটি অংশীদার। অতীতের মতো তারা অপর পক্ষের হাতে একতরফা মার খেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। জনসচেতনতা ও জনশক্তির অস্ত্রকে বাজারের শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার জন্য কাজে লাগানো দরকার, যাতে বাজারে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, দ্রব্যমূল্যে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও পণ্যের কৃত্রিম সংকট না হয়। বারবার যেন রমজান বা অন্য কোনো উপলক্ষ্যে সাধারণ মানুষ বলির পাঁঠা না হয়, এটা নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে কোনো অজুহাত নয়, যারাই বাজারসংশ্লিষ্ট দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, প্রত্যেককে বিচারের আওতায় না আনা গেলে পুরোনো চিত্রই বারবার জনগণকে দেখতে হবে। অতএব, চলমান সংস্কারের অংশ হিসাবে সরকার অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দমনে যথাযথ ও কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, এটাই প্রত্যাশিত।
প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ : চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়