বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় ঐক্য

ব্রি. জে. (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পর্ব-২
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেওয়ার বিষয়টি প্রকৃতগত। কারণ আমরা ভৌত (Physical) উন্নয়নে খুব জোর দিয়েছি, নৈতিক উন্নয়নে নয় (Metaphysical)। সে কারণে যে কোনোভাবে আমরা একটি শ্রেণি অর্থ-সম্পদ আহরণে অনেক সময় ও শ্রম দিয়েছে। আজ ‘পড়ালেখা করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’, এ প্রবাদ প্রায় মূল্যহীন। সেজন্যই আমাদের অনেক মেধাবী তরুণ বিদেশে পড়তে যায়। তারা অনেকেই না ফেরত আসার কথা যাত্রার আগেই বলে যায়। অনেকেই বিদেশে গমন করে সিদ্ধান্ত নেয় ‘বাংলাদেশে না ফেরাই ভালো’, কারণ সুস্থ প্রতিযোগিতার জায়গাগুলোকে তারা অস্বচ্ছ মনে করে। দেশের দুর্নীতির চিত্রও খারাপ। ২০০৩-০৪ সালে প্রথমবারের মতো শান্তিরক্ষী হয়ে কাজ করার সময় টিআইবির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও (টিআইবির) প্রতিবেদন দেখলাম। আমাদের দেখিয়ে অন্য দেশের শান্তিরক্ষীরা আলাপ করত ‘এই পেশাদার, দক্ষ ও সৎ শান্তিরক্ষীর দেশ কখনো এত দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে না।’ সেদিন থেকে আমি বুঝতে শুরু করলাম, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভিন্নতা। কিন্তু বিগত এক দশকে আমরা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সে ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারিনি। এজন্য আমি কখনো পুরো সেনাবাহিনীকে দায়ী করি না। কারণ ‘Leadership is always top down, it was never bottom up’। ৩৬ জুলাইয়ের ইতিহাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান বাংলাদেশ নামক গণতান্ত্রিক দেশকে সম্মানিত করেছে। তবে সামাজিক মাধ্যমে সব প্রকাশিত তথ্য শতভাগ সত্য নয়। এজন্যই দেশপ্রেমিক সৎ সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে যেতে পারে। যেহেতু সেনাবাহিনী একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান; সুতরাং তাদের নিয়ে এমন ঢালাও মন্তব্য কাম্য নয়। কারণ দেশের ক্রান্তিলগ্নে এমনকি ৩৬ জুলাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সেনাবাহিনী গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছে। ভবিষ্যতে যুদ্ধসহ সব জাতীয় ঝুঁকিপূর্ণ মুহূর্তে এ সেনাবাহিনীই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। তাই নাগরিক হিসাবে সেনাবাহিনীর প্রতি ভাষা নিয়ে আমাদের ভাবার আছে। কারণ কোনো ব্যক্তির অন্যায় কর্মের দায়, অসৎ কর্মকাণ্ডের ফসল কখনো পুরো সেনাবাহিনী নেবে না। সেনাবাহিনীকে (গৌরবময় প্রতিষ্ঠানকে) তার দায় দেওয়াটা প্রচণ্ড অন্যায়। কেন কোনো অপরাধী ও অন্যায়কারীর দায় সেনাবাহিনী নেবে? প্রথমত, প্রতিটি দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠান পদ-পদবি দিয়ে প্রবল বিশ্বাস স্থাপন করে, তার কাছ থেকে সঠিক ন্যায়নিষ্ঠ কাজ প্রত্যাশা করে। ঊর্ধ্বতন সদর থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লিখিত নির্দেশ আসে। সে নির্দেশে কোনো অস্বচ্ছতা, অপূর্ণতা আমি ৩৪ বছর চাকরি জীবনে দেখিনি। কিন্তু অলিখিত ও গোপন নির্দেশ কীভাবে কোথা থেকে উৎপত্তি হয়, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে। তাই প্রবল ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াসে এবং ভয়ে অনেকেই অন্যায় আদেশ পালন করে, করতে বাধ্য হয়। কারণ তার প্রশিক্ষণ রয়েছে বিনাবাক্যে আনুগত্য করার। সে কারণেই যাদের ব্যক্তিগতপ্রাপ্তি ও সম্পদ তার সমসাময়িকদের থেকে অতি বেশি এবং ভিন্ন, তাদের অপরাধ করার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়টি রাষ্ট্রের খতিয়ে অবশ্যই দেখতে হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ সব বাহিনী, ক্যাডার, সংস্থার ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য।
তাই জুলাই বিপ্লবের পরে আমাদের ভাষা হোক অসুস্থ, অসৎ, দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়। কারণ পেশাদার নিষ্ঠাবোধসম্পন্ন, উন্নত নৈতিকতাবোধের অফিসাররা কখনোই এত অপকর্ম হচ্ছে বা হবে, জানতে ও বুঝতেই পারে না। বিষয়টি এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। তবে বিশ্বাস না হলেও সেনাবাহিনী সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। সেনাবাহিনী সত্যিকারেই একটি সার্বক্ষণিক কাজের বাহিনী। এটি চাকরি নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। একজন সৎ, যোগ্য, দক্ষ, মানবিক ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হওয়ার সব উপাদান এখানে বিদ্যমান। আমার মতে, এটি দেশের মধ্যে ক্ষুদ্র একটা দেশ। কারণ দেশের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য এলাকায় সেনানিবাস রয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পেশাদার সম্পর্ক রয়েছে। দেশে যুদ্ধ বা বিপদসংকুল যে কোনো পরিস্থিতিতে এরিয়া কমান্ডাররা (যারা বর্তমানে জিওসি) সব বিষয়ে সমন্বয় করে দেশবাসীকে রক্ষা ও সেবা দেবেন। একটি গাছ যেমন চারা থেকে সঠিক পরিচর্যায় বড় হয়ে ওঠে, তেমনি একজন সেনা অফিসার সেকেন্ড লে. (আমাদের সময়ের প্রথম পদবি) থেকে অনেক পথপরিক্রমা, পরীক্ষা, যাচাই-বাছাইয়ের পর সিনিয়র অফিসার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এবং বিশ্লেষণ ছাড়া দুর্নীতি ও অপকর্মের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। কারণ অপবাদ মিথ্যা হলে, অন্যায়ভাবে তার পরিবার ও সমাজের কাছে তিনি বা তারা হেয়প্রতিপন্ন হবেন। এখানে মনে রাখতে হবে, বাবা বা মা অপরাধ করতেই পারে। সেজন্য তাদের সন্তানরা কষ্ট পাবে কেন? এমন সংস্কৃতি থেকে আমাদের দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে, বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজকে। আমাদের তরুণদের মনে রাখতে হবে সত্যের একটি শক্তি আছে, যা একতাবদ্ধভাবে বেরিয়ে আসবে। অতীতেও সত্য ও সততা জাতীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে এবং বিস্ময়কর একটি ফলাফল এনে দিয়েছে। যেমন হয়েছে ১৯৭১-এ এবং জুলাই ২০২৪-এ।
এবার আসা যাক আমরা কীভাবে বলব, লিখব এবং ভাষার ব্যবহার করব। প্রথমেই আমরা আজ থেকে বেশি বেশি পড়ব, তারপর নীরবে একা একা ভাবব বা কারও সঙ্গে আলোচনা করব, সব শেষে কোনো বিষয়ে লিখব বা বলব। আমাদের বলার ও লেখার লোক এত বেশি যে, জ্ঞানার্জনের সুযোগ ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। মানুষের অশ্লীল ভাষার ব্যবহার, বড়দের প্রতি সম্মানবোধ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এজন্য বিদ্বান ও সৃজনশীলরা আলোকিত হওয়ার প্রয়াস বা ইচ্ছে হারিয়ে ফেলছেন। এখন সবাই রাজা। তরুণদের মধ্যে ইউটিউবার হওয়ার এবং তা থেকে অনেক অর্থ আয় করার লোভ বেড়েছে। তাতে কিন্তু নতুন প্রজন্ম ভালো কিছু শিখবে বলে আমার মনে হয় না। জ্ঞানী, ব্যক্তিত্ববান, সৃজনদের লেখা ও বক্তব্য ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তথ্যপ্রবাহের যুগে অনেক ভুল বা শুদ্ধ তথ্য নিয়ে আমরা হাজির হয়ে যাচ্ছি। তারেক শামসুর রেহমান নামক একজন অধ্যাপককে আজ খুব মনে পড়ছে। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হয়েও ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ৫০ বছর’-এর মতো ভালো বই লিখেছিলেন। আজকে যে ছাত্ররা বাংলাদেশে একটি বিপ্লব ঘটানোর মতো কাজ করল, তারা অনেকেই হয়তো স্যারের বইটি পড়েছেন। ক্লাসে তাকে প্রশ্ন করছেন, অনেক ডিবেট নিশ্চয়ই হয়েছে। আজ অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান নেই। তার শূন্যতা অনুভব করছে পুরো জাতি। আমার প্রশ্ন, নতুনরা অবশ্যই আসবে। তবে তাদের প্রবেশ যেন আলোর পথ ধরে হয়। তরুণদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশের গবেষণাগার বাংলাদেশের ‘Youth Bulge’ নিয়ে কাজ করেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক পেশাদার কর্মকর্তা গবেষক হিসাবে কাজ করেছেন। আজ যেভাবে দেশ এগোচ্ছে, তাতে তৃতীয়পক্ষ লাভবান হতে পারে, যদি না আমরা বুঝতে শুরু করি। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না বিশ্বপঠনে শীর্ষে রয়েছে ভারত। তারপর চীন, থাইল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে ভিন্ন র্যাংকিং হলেও বাংলাদেশের কোনো নাম এ পর্যন্ত আমি ৪০/৫০-এর মধ্যে দেখিনি। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ুয়া ও লেখকদের সঠিক মর্যাদা দেওয়া হয় বলে মনে হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। (আগামীকাল শেষ পর্ব)
ব্রি. জে. (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও গবেষক