Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

অজানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে কবে

Icon

ফয়সাল আকবর

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অজানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে কবে

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো অধ্যায় পিলখানা ট্র্যাজেডি। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে দেশপ্রেমিক সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। এ ট্র্যাজেডি জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের একটি।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় নিমর্ম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সামরিক কর্মকর্তা। এছাড়া বিডিআর সদস্য ও বেসামরিকসহ আরও ১৭ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে একজন মেজর জেনারেল, দুজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, ১৬ জন কর্নেল, ১২ জন লে. কর্নেল, ২৫ জন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সামরিক ইতিহাসে একদিনে এত বিশালসংখ্যক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুর নজির খুঁজে পাওয়া যায় না।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখতে পাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডি-ডে বা স্ট্যালিনগ্রাদ যুদ্ধে হাজার হাজার সেনা কর্মকর্তা মারা যায়। ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের টেট অফেনসিভে অতর্কিত হামলায় বেশকিছু উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা নিহত হলেও তা পঞ্চাশের বেশি নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ ও ইউক্রেনীয় অফিসাররা উচ্চ সংখ্যায় মারা গেলেও একদিনে এত বিশালসংখ্যক মারা যায়নি।

পিলখানা ট্র্যাজেডির নেপথ্যে কী ছিল

পিলখানা ট্র্যাজেডি কি শুধুই বিডিআর বিদ্রোহ, নাকি দেশবিরোধী এক গভীর ষড়যন্ত্র-তার পুঙ্খানুপুঙ্খ উদ্ঘাটন একান্ত আবশ্যক। জাতিরাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকতে এ আবশ্যকতা তৈরি হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকসহ নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের অনেকে ঘটনাটিকে ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ বলতে চান না। তাদের মতে, পুরো বিষয়টি ছিল সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি আসছে আওয়ামী লীগ সরকার ও ভারতের নাম। কথিত প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং দেশের কিছু বিশ্বাসঘাতকের যৌথ আয়োজনে পিলখানা হত্যাকাণ্ড হয়েছিল বলে দাবি করেছেন সেনাবাহিনীর তদন্ত আদালতের দ্বিতীয় প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন।

সম্প্রতি তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিদ্রোহের অনেক আগে থেকেই আওয়ামী লীগের কিছু নেতার সঙ্গে বিডিআর জওয়ানরা পরিকল্পনা করে আসছিল।

২০০৮ সালের ১৭-১৮ ডিসেম্বর ফজলে নূর তাপসের বাসায় কয়েকজন বিডিআর সদস্য বৈঠক করেন। নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যায় বিডিআর দরবারসংলগ্ন মাঠেও কয়েকজন বিডিআর সদস্য এবং বেসামরিক ব্যক্তি জাকিরসহ বৈঠক করেন। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় রাজধানীর বনানীতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের বাসায় বিডিআরের ডিএডি হাবিব, ডিএডি জলিলসহ কয়েকজন বেসামরিক লোক বৈঠক করেন।’

এছাড়া আরও কিছু বাস্তবতার কারণে এমন ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়। যেমন, পিলখানায় হত্যাকাণ্ড চলাকালে বাংলাদেশের মিডিয়ায় খবর প্রকাশের আগেই ভারতের মিডিয়ায় মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের নিহত হওয়ার খবর প্রচারিত হওয়া। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া নথি থেকে জানা যায়, ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিবশংকর মেননকে সাহায্য চেয়ে বার্তা দিয়েছিলেন।

সম্প্রতি দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘‘এ হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিক, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, শেখ ফজলে নূর তাপস এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের কিছু কর্মকর্তা।’’ আমাদের বিশ্বাস, সদ্য গঠিত কমিশন অবশ্যই নেপথ্যের এবং গভীর নেপথ্যে জড়িতদেরও চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে।

যেসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা

পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ১৬ বছর পার হলেও এবং আগের তদন্ত কমিটি ও বিচারিক কার্যক্রমের একটি বড় অংশ শেষ হলেও এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করতে না পারলে যড়যন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটন করা কঠিন। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দরবার সকাল ৮টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কেন দরবার এক ঘণ্টা পিছিয়ে সকাল ৯টায় শুরু করা হয়, তা আজও অজানা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শুরুতে ঘটনার সময় দরবারে থাকা একটি ভিডিও ক্যামেরার কথা বললেও সেই ক্যামেরাটি পরে উদ্ধার করা যায়নি কেন? দেশবিরোধী এত বড় ষড়যন্ত্র অথচ সেনা গোয়েন্দা ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা অবগত ছিল না? আমরা পত্রিকার বরাতে জেনেছি, বিডিআরের প্রয়াত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ওই দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হওয়া সেই কথোপকথন তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে কেন লিপিবদ্ধ করা হয়নি? সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয়, একটি সামরিক সমস্যা সমাধানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেন সামরিক পদক্ষেপ না নিয়ে তার দলের নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাও আবার চার ঘণ্টা পরে? তিনি কেন একটি সামরিক সমস্যাকে সমাধানের পথ রাজনৈতিক নেতাদের হাতে দিয়েছিলেন-এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাওয়া অতীব জরুরি। আমরা দেখেছি, কথিত বিদ্রোহীরা শেখ হাসিনাকে আমাদের নেত্রী বলেছিল এবং কিছু বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান দিয়েছিল। তাদের এমন আচরণের নেপথ্যে কী ছিল সেটা জানাও জরুরি। আটকে পড়া সেনাসদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারে অভিযান পরিচালনায় জনচাপ থাকলেও কেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিলখানায় সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দিলেন না? এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে সেনা ও বিমান বাহিনী ধানমন্ডি অবস্থান করলেও কেন তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়? অথচ তখনো অভিযান পরিচালনা করলে হয়তো কিছু সেনা কর্মকর্তা রক্ষা পেতেন। তা না হলেও অন্তত মূল অপরাধীদের শনাক্ত করা যেত। বিদ্রোহের পর বিভিন্ন ভাষ্যে এসেছে, ২৫ ফেব্রুয়ারি মুখে কাপড় বাঁধা একটি বিশেষ গ্রুপ মূলত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, সেই গ্রুপটি কারা? এ প্রশ্নের উত্তর ছাড়া প্রকৃত অপরাধী ও নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে দুরভিসন্ধি লাগে, কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদেরই বিডিআরে একত্রিত করা হয়েছিল? এত বড় হত্যাকাণ্ডের পরও ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা থেমে ছিল না। পরবর্তীকালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সোচ্চার প্রায় ১০০ সেনা কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল কেন? পিলখানা ট্র্যাজেডির অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে সন্দেহে থাকা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দেশপ্রেমিক জনতা শুধু বিচারই চায় না, একইসঙ্গে উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব চায়, যাতে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের শেকড় উপড়ে ফেলা যায়। আমাদের সুস্পষ্ট প্রত্যাশা, জনআকাঙ্ক্ষার মুখে গঠিত নতুন কমিশন অবশ্যই উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব বের করবে। এ কমিশনের দুজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং জানি, যারা দেশের প্রতি প্রকৃত অর্থে অঙ্গীকারবদ্ধ বলে মনে হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে কার্পণ্য কেন

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়কর ঘটনা ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির বীর শহিদদের কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সুপরিকল্পিতভাবে এই দিন এবং শহিদদের বিষয় আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। অবশেষে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দুদিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে গ-শ্রেণিভুক্ত ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করেছে। আমরা নিঃসন্দেহে এ স্বীকৃতিকে স্বাগত জানাই। কিন্তু পিলখানার ট্র্যাজেডির ব্যাপকতার বিচারে এ স্বীকৃতিতে কিছুটা কার্পণ্য প্রকাশ পেয়েছে। পিলখানা ট্র্যাজেডিই একমাত্র বিষয় যা এদেশের সব মতের মানুষের কাছে এক গভীর শোকের বিষয়। এজন্য দেশপ্রেমিক জনতার দাবি, ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ক-শ্রেণিভুক্ত জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করাই উত্তম। এ ছাড়া ঘটনার ব্যাপকতা বিবেচনা করে এবং সূদূরপ্রসারী প্রভাব মাথায় রেখেও ২৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা উচিত, যাতে শহিদ সেনা কর্মকর্তাদের আত্মত্যাগের প্রতি সর্বস্তরের জনগণ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। এমন স্বীকৃতি ভবিষ্যতে এ ধরনের ট্র্যাজেডির বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মারক হিসাবে কাজ করবে। এ ছাড়া জাতীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যে জাতীয় সংহতি, ঐতিহাসিক সচেতনতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা সচেতনতা অধিক শক্তিশালী হবে।

সর্বশেষ, আমার দৃঢ বিশ্বাস, আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে কমিশন নিশ্চয়ই পিলখানা ট্র্যাজেডির সব ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচন করবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতরা যত বড় শক্তি বা ব্যক্তি হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেবে। সেই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতির বিবেচনায় ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির শহিদদের অধিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করবে।

ফয়সাল আকবর : শিক্ষক ও গবেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম