পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বাধা দিয়ে জীবন দিয়েছেন যিনি

আশরাফুল আলম হান্নান
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পিলখানায় সেদিন হাজার হাজার জওয়ান হত্যাকাণ্ডের পক্ষে ছিল। তারা খুঁজে খুঁজে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করছে নৃশংসভাবে। ওই অবস্থায় কোনো কোনো বিডিআর সদস্য হয়তো এ হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেননি, কিন্তু কেউ সেভাবে এর প্রতিবাদও করেননি। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি হলেন বিডিআরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম। তিনি আমার বাবা। তিনি এ হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় দরবারে যোগ দিতে দেরি হয়ে যাবে-এ আশঙ্কায় বাবা সকালে নাশতা না খেয়েই বাসা থেকে বের হয়ে যান। সেদিন আমার পরীক্ষা ছিল, বাবা খাবার খেয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু দেরি হয়ে যাবে বলে নিজে না খেয়ে দরবারে চলে যান। এ যাওয়ার ৭ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে বাবার মৃতদেহ গ্রহণ করি। এই ৭ দিনে এমন কোনো হাসপাতাল নেই, যেখানে বাবার খোঁজ করিনি। ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত অন্যদের মতো বাবার লাশ গণকবর থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। পরে ওই বছরের ৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরলক্ষ্মী গ্রামের বাড়িতে বাবার লাশ দাফন করা হয়।
বিডিআর সদর দপ্তরে কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর হিসাবে তিনি ছিলেন বিডিআরের প্রতিনিধি। মহাপরিচালকের সঙ্গে তার ছিল সরাসরি দাপ্তরিক সম্পর্ক। সেদিন ঘটনা শুরুর মুহূর্তে মহাপরিচালকের নির্দেশে তিনি মাইকযোগে জওয়ানদের শান্ত হতে বারবার বিভিন্নভাবে অনুরোধ জানান, এগিয়ে যান সশস্ত্র জওয়ানদের প্রতিরোধ করতে, হত্যাকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় পর চারজন বিডিআর সদস্য তার কাছ থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে তাকে লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে পেটে ক্ষতবিক্ষত করে; পরে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে নুরুল ইসলামের এই বীরত্বের কথা। এ হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস পর তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে শহিদের মর্যাদা পান এবং পরবর্তীকালে তাকে বিজিবির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ পদকে ভূষিত করা হয়।
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিচল আস্থা, প্রশ্নাতীত আনুগত্য এবং অতি উন্নতমানের সৈনিকসুলভ আচরণ প্রদর্শনপূর্বক অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে হত্যাকারীদের বর্বরোচিত কাজে বাধা প্রদান করায় হত্যাকারীরা তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে গণকবরে নিক্ষেপ করে।
বাবা ছিলেন খুবই পরহেজগার মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন ও কুরআন তেলাওয়াত করতেন নিয়মিত। প্রতি শুক্রবার দাড়ি ও চুলে মেহেদি লাগাতেন। ২৫ ফেব্রুয়ারির নির্মম ঘটনায় তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, তিন কন্যা ও এক পুত্র। কর্মজীবনে তিনি চারবার ডিজি পদক পেয়েছেন। নুরুল ইসলাম চাকরিজীবনে একজন সৎ মানুষ হিসাবে সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তিনি শ্রেষ্ঠ বিওপি কমান্ডার ও শ্রেষ্ঠ কোম্পানি কমান্ডারের স্বীকৃতি লাভ করেন। চোরাচালান রোধে তিনি পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার। রাইফেলস ট্রেনিং সেন্টারেও প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ আট বছর। ২০২১ সালে পাদুয়া যুদ্ধে সংগ্রাম ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম।
আমার বাবা হত্যাকারীদের হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত রাখা এবং শহিদদের বাঁচাতে গিয়ে বীরের মতো জীবন দিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসের এ ধরনের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতায় বাধাদানকারী এবং ১২০-এর অধিক সেনা অফিসারের জীবনরক্ষার চেষ্টাকারী শহিদ হিসাবে আমরা বাবাকে বীরত্বসূচক রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করছি। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার প্রকৃত কুশীলব এবং প্রকৃত হত্যাকারী ও অপরাধীদের বিচার, শহিদদের মূল্যায়ন এবং পরিবারকে সম্মান প্রদানের দাবি জানাই।
আশরাফুল আলম হান্নান : কেন্দ্রীয় সুবেদার শহিদ মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে