Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

১৫ আগস্ট : অন্য চোখে

Icon

আহমাদ শিহাব

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৫ আগস্ট। একটি ঐতিহাসিক দিন। অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। পঁচাত্তরের এই দিন একটি সেনা অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক শেখ মুজিবুর রহমানের পতন হয়। দুঃখজনক যদিও, সেদিনের সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়ায় তার মৃতু ঘটে। কিন্তু সেই মৃত্যুতে সেদিন কারও চোখে পানি দেখা যায়নি, ছিল না কোনো পরিতাপ। শোনা যায়নি ইন্নালিল্লাহ। স্বেচ্ছায় কেউ যেতে চায়নি তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। দেখা গেছে, শুধু আনন্দ-উল্লাস ও উৎসবের মিছিল। যেমনটি হয়েছিল গত ৫ অগাস্ট, ২০২৪ মুজিবকন্যা, মুজিব অনুসারী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার উৎখাতে। হাসিনা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে, যারা দিয়েছিল তার দু’দশক শাসনামলের প্রভুত্ব।

শেখ হাসিনা দিনটিকে (১৫ আগস্ট) ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করে এবং তার সরকার সে হিসাবে পালন করে আসছিল। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা বাতিল করে দেয়।

মুজিবের পতন অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল না, দেশের জনগণ প্রতিটি মুহূর্তে তা কামনা করেছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের কোনো সাংবিধানিক সুযোগ খোলা রাখেনি মুজিব। শোষিত জনগণ শুধু আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া চাইত মুজিবের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে রেহাই, একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি। আল্লাহ জনগণের সেই আর্জি কবুল করেছেন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। একগুচ্ছ সেনা অফিসার ও শ’পাঁচেক সৈনিক দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা সমাধা করে। ঘটনাক্রমে মুজিবসহ ডজন দুয়েক লোক মারা পড়ে। একজন বিদেশি জজ মন্তব্য করেছিলেন, এমন একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনায় ২২ জন লোকের মৃত্যু বড় কিছু নয়, যেখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অঘটনে ও অবিচারে অনেক লোক মারা পড়ে।

দেশ বাঁচানো

মুজিব আমলের বাংলাদেশ যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে মুজিব কীরূপ অত্যাচারী ও জঘন্য স্বৈরশাসক ছিলেন। সারাজীবন গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করে ক্ষমতা হাতে পেয়েই তিনি ওসব রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ ছুড়ে ফেলে দিলেন একচ্ছত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়াসে, কোনো বিরোধ বা প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়া। প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক খুশবন্ত সিং তার ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে লিখেছিলেন, মুজিব কোনো পরামর্শ নিতেন না, শত্রু রাখতেন না, ছিলেন জনগণ থেকে বিশ্রুত, বিমুখ। যারা সামনে তাকে বঙ্গবন্ধু বলত, পেছনে গিয়ে বঙ্গশত্রু বলে গালাগালি করত।

মুজিবের ৪৪ মাসের শাসনামলের বৃত্তান্ত, তথা গুম-খুন, জেল-জুলুম, অত্যাচার-অবিচার-ব্যভিচার, সীমাহীন লুটতরাজ লিখতে গেলে পাহাড়সম স্তূপ হবে। প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ‘ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড বিজেতা’ জাগলুল হোসেন মুজিবকে নিয়ে লেখার কিছুটা নিচে তুলে ধরলাম :

‘মুজিব সরকার ৩০ হাজার দেশপ্রেমিক হত্যা করে। তাদের অপশাসনে দেশে নেমে আসে নির্বিচার হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, লুণ্ঠন, দখলবাজি, সীমান্ত পাচার ইত্যাদির বিভীষিকা। তাদের অপশাসন, লুণ্ঠন, কালোবাজারি, সীমান্ত পাচারের ফলে দেশে যে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ঘটে, তাতে সরাসরি মৃত্যু হয় ৫ লাখ মানুষের এবং পরোক্ষভাবে মৃত্যু হয় আরও ১০ লাখ মানুষের। অন্যদিকে, মুজিব নিজে ভারতপন্থি না হলেও মুজিব সরকার পরিচালিত হয় মূলত ভারতের নির্দেশে, যারা বাকশালতন্ত্র নামক চরম স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি করে। মুজিব নিজে ২৫ মার্চ ১৯৭১ নিজের ও নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, পরিবারের জন্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে, ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করেন।’ (বস্তুত, মুক্তির সংগ্রাম থেকে পালিয়ে যান।)

একাত্তরে পাকিস্তানের জেলে থাকাকালে মুজিবের খানসামা রাজা আনার খান (বস্তুত একজন পুলিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা) ২০১৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ২২ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভাঙার খবর শুনে মুজিবের সে কী উগ্রমূর্তি, আহাজারি এবং তাজউদ্দীনকে গালাগালি!

(বিস্তারিত দেখুন: https://southasiajournal.net/bangladesh-sheikh-mujibs-stance-on-independent-bangladesh-sensational-revelation/)

১৫ আগস্ট বিপ্লবের পর বিপ্লবী নেতাদের মনোনীত নেতা জিয়াউর রহমানের হাত ধরে, অতি শিগ্গির দেশে শান্তি আসে, স্থিতিশীলতা আসে, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, দেশ উন্নতির দিকে ধাবিত হয়, বহির্বিশ্বে সুনাম অর্জন করে।

সূর্যসন্তান

অথচ, যারা এ অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছিল, সেদিনের সূর্য সন্তানরা, রয়ে গেল অবহেলিত, বঞ্চিত। ডজনখানেক অফিসারদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢুকিয়ে বিদেশের ছোটখাটো, নিু গুরুত্ব মিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়। অধিকাংশই ছিল পাওনা, পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

১৯৯৬ সালে কতকটা ধোঁকার মাধ্যমে হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথম কাজটি করেন তার পিতৃহত্যার প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের কার্যক্রম। দেশে-বিদেশে যেখানে যাকেই পাওয়া গেছে, ধরে আনা হলো। লোকদেখানোর জন্য পাতানো ছিল রাজনৈতিক ও একতরফা দলীয় বিচারের প্রহসন। সঠিক সুযোগ ছিল না কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের। যে ক্ষেত্রে ধরে আনা, বন্দি করে নির্যাতন করা, অনুসন্ধান, প্রসিকিউশন, বিচার ও এক্সেকিউশন একই ব্যক্তির হাতে (Judge, jury and executioner rest in one hand), ফল তাই হলো। হাতে পাওয়া আধা ডজন সূর্যসন্তানদের ফাঁসিতে ঝুলানো হলো। বাকিদের হন্যে হয়ে খোঁজা হয়।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আশা করা যায়, দেশে আবারও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। প্রায় পাঁচ যুগ আগে যাদের প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিশ্চিত ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছিল, দেশ সত্যিকার অর্থে মুক্তি পেয়েছিল, তাদের সঠিক মূল্যায়ন হবে। ১৫ আগস্টের অবদান ইতিহাসে যথাযথ মর্যাদার স্থান পাবে।

এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একান্ত অনুরোধ।

আহমাদ শিহাব : মানবাধিকার কর্মী, লেখক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম