Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

‘রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন রাখার দিন শেষ’

Icon

টেড স্নাইডার

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন রাখার দিন শেষ’

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রচারণা চালায়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুদ্ধ শুরুর পর পুতিনের সঙ্গে একবারও কথা বলেননি।

বিচ্ছিন্নতার সেই নীতি এখন শেষ হয়েছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি পুতিনের সঙ্গে ‘দীর্ঘ এবং অত্যন্ত ফলপ্রসূ ফোনালাপ’ করেছেন। ট্রাম্প শুধু সাবধানতার সঙ্গে দরজা খোলেননি, বরং সেটি পুরোপুরিই খুলে দিয়েছেন। তিনি শুধু ভবিষ্যতে ফোনালাপের ব্যাপারে সম্মত হননি; তিনি মস্কোতে যাওয়ার এবং পুতিনের ওয়াশিংটনে আসার ব্যাপারেও সম্মতি দিয়েছেন : ‘আমরা একে অপরের দেশ পরিদর্শনসহ খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছি।’

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ট্রাম্প মনে হয় রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানাতে চান। ট্রাম্প বলেন, তিনি এবং পুতিন ‘আমাদের একসঙ্গে কাজ করার’ যে বিশাল সুবিধা আছে, তা নিয়ে কথা বলেছেন।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, ট্রাম্প ও পুতিনের ফোনালাপ প্রায় দেড় ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল এবং তারা একমত হয়েছেন যে, ‘আমাদের একসঙ্গে কাজ করার সময় এসেছে।’

যেদিন ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, সেদিনই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ন্যাটো এবং ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি ট্রাম্পের অবস্থানের সবচেয়ে পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন। ট্রাম্প ও হেগসেথের বিবৃতিগুলো একত্রে শান্তি পরিকল্পনার পরিসীমা সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়। হেগসেথ স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে না ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর সদস্যপদ একটি বাস্তবসম্মত ফল দেবে।’ এটি ইউক্রেনের জন্য একটি বড় আঘাত এবং পেসকভের বিবৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পেসকভ বলেছেন, ‘ফোনালাপে পুতিন তার পক্ষ থেকে সংঘাতের মূল কারণগুলো দূর করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন।’ এই বিবৃতিগুলো একত্রে ইঙ্গিত দেয় যে, পুতিন যুদ্ধে যাওয়ার মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন, অর্থাৎ ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে না এমন একটি লিখিত গ্যারান্টি পাওয়া।

আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টি খারিজ হয়ে যাওয়ার পর ইউক্রেনের জন্য পরবর্তী সেরা নিরাপত্তা গ্যারান্টি হতে পারত একটি বৃহৎ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন। কিন্তু হেগসেথ বলেছেন, ‘যে কোনো নিরাপত্তা গ্যারান্টির অংশ হিসাবে ইউক্রেনে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হবে না, যা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির জন্য দ্বিতীয় আঘাত।

হেগসেথ আরও বলেন, এখন থেকে ‘ইউরোপকে ইউক্রেনের জন্য ভবিষ্যতে মারাত্মক ও অমারাত্মক অস্ত্র প্রদান করতে হবে।’ এ বক্তব্য ইঙ্গিত করে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের পর কেবল শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, বরং যুদ্ধের সময় অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টিও ইউরোপের ওপর ছেড়ে দেবে। হেগসেথ প্রকাশ করেন, আমেরিকার মূল্যায়নে ‘ইউক্রেনের ২০১৪ সালের আগের সীমানায় ফিরে যাওয়া একটি অবাস্তব অভিপ্রায়’ এবং ‘এই মায়াবী লক্ষ্যকে তাড়া করা শুধু যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করবে এবং আরও বেশি কষ্ট সৃষ্টি করবে।’ এই বিবৃতি ইঙ্গিত করে, রাশিয়া অন্তত ক্রিমিয়া ও দনবাসের দখলকৃত অংশ ধরে রাখবে।

ট্রাম্প এবং হেগসেথের মন্তব্যগুলো এখনো ইউক্রেনের অংশে থাকা জাতিগত রাশিয়ানদের ভাষাগত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রশ্নে কোনো অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে না। ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর আকার ও ক্ষমতার ওপর কোনো সীমা আরোপের বিষয়েও নয়।

ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে কথা বলার পর জেলেনস্কির সঙ্গে এক ঘণ্টা কথা বলেন। দুই ফোনালাপের পর তিন নেতার বিবৃতি ইউক্রেনের জন্য আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিল যে, তারা ইউক্রেনকে আলোচনার জন্য চাপ দেবে না, যতক্ষণ না তারা প্রস্তুত হয় এবং ইউক্রেনকে ছাড়া ইউক্রেন সম্পর্কে কিছু করা হবে না। সেই দুটি প্রতিশ্রুতিই মুছে যাওয়ার মতো মনে হচ্ছে।

তার ফোনকলের পর জেলেনস্কি বলেন, ‘শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছি। দীর্ঘ আলোচনা। শান্তি অর্জনের সম্ভাবনা সম্পর্কে। একসঙ্গে কাজ করার আমাদের ইচ্ছা সম্পর্কে...আমরা রুশ আগ্রাসন বন্ধ করতে এবং একটি নির্ভরযোগ্য, স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে আমেরিকার সঙ্গে আমাদের যৌথ পদক্ষেপ নির্ধারণ করছি।’

কিন্তু ট্রাম্প ইউক্রেনের সঙ্গে যৌথ পদক্ষেপ নির্ধারণ বা প্রেসিডেন্ট-টু-প্রেসিডেন্ট পর্যায়ে প্রথম রাউন্ডের আলোচনায় ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে কিছুই বলেননি। পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পর তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘আমরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ফোন করে তাকে আলোচনার কথা জানাব।’ এবং জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনকলের পর তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছি। কথোপকথনটি খুব ভালো হয়েছে।’ তিনি বলেছিলেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং জেলেনস্কির মধ্যে একটি নিুপর্যায়ের বৈঠক ইতোমধ্যেই নির্ধারিত মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হবে।

পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পর ট্রাম্প কেবল ‘আমাদের নিজ নিজ দলকে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করার জন্য সম্মত’ হওয়ার কথা বলেছিলেন, যা শুধু ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে বলে মনে হয়। আলোচনায় অন্তত প্রাথমিকভাবে ইউক্রেনকে বাদ দেওয়ার আশঙ্কাটি ট্রাম্পের পরবর্তী বিবৃতির মাধ্যমে নিশ্চিত বলে মনে হয়েছে : তিনি এবং পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, যা ‘খুব দূরবর্তী ভবিষ্যতে নয়’। ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমরা শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎ করব বলে আশা করি। আসলে, আমরা আশা করি যে তিনি এখানে আসবেন, এবং আমি সেখানে যাব, এবং আমরা সম্ভবত প্রথমবার সৌদি আরবে সাক্ষাৎ করব, আমরা সৌদি আরবে সাক্ষাৎ করব, দেখি কিছু করা যায় কিনা।’ একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, জেলেনস্কি ছাড়া পুতিনের সঙ্গে বৈঠক হবে কিনা? ট্রাম্প উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সম্ভবত প্রথম বৈঠক করব, এবং তারপর দ্বিতীয় বৈঠক সম্পর্কে আমরা কী করতে পারি তা দেখব।’

যদিও ট্রাম্প বলেছেন, তিনি মস্কো যাবেন এবং পুতিন ওয়াশিংটনে আসবেন; একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘না, আমি ইউক্রেনে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেইনি।’

ট্রাম্পের পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনালাপ এবং পরবর্তী বিবৃতিগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার দিন শেষ হয়েছে। আরও ইঙ্গিত মেলে, যুদ্ধ শেষ করার শর্তের প্রথম রাউন্ডের আলোচনাগুলো ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে পারে। হেগসেথ ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেই শর্তগুলো ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর সদস্যপদ না থাকার রাশিয়ার মূল দাবিকে সমর্থন করতে পারে।

antiwar.com থেকে অনূদিত

টেড স্নাইডার : মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও ইতিহাস বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম