পশ্চিমা মিডিয়ায় সুদান কেন উপেক্ষিত

ওমর সুলেমান
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
গেল রোববার রাতে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত সুপার বোলের (রাগবি ম্যাচ) হাফটাইম শোয়ের আড়ম্বরের মাঝে একজন পারফরমারকে সুদান ও ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াতে দেখা যায়। সুপার বোলের মতো একটি নিয়ন্ত্রিত ইভেন্টে এ বিঘ্নটি ছিল সংক্ষিপ্ত এবং নিরাপত্তা বাহিনী তা দ্রুত সামাল দেয়। সরাসরি সম্প্রচারে এ দৃশ্যটি দেখানোও হয়নি; কিন্তু সেই মুহূর্তটি, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
প্রকৃতপক্ষে, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সুদান ও ফিলিস্তিনের জনগণ তাদের কথা বলার জন্য সবরকম চেষ্টা করেছে। তারা প্রতিবাদ করেছে, সংগঠিত হয়েছে এবং তাদের সংগ্রামের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল সে আওয়াজ শুনতে অস্বীকার করেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাই প্রথম নয়, গত বছরও লাখ লাখ আমেরিকান যখন খেলা দেখছিলেন, তখনো ফিলিস্তিনে ইসরাইলের গণহত্যা অব্যাহত ছিল। সেসময় মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাফায় অন্তত ৬৭ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। তা-ও আবার এমন একটি এলাকায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী হামলা চালায়, যেটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ হিসাবে মনোনীত হয়েছিল এবং সেখানে ১৪ লাখ ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। এটি বিভ্রান্তিকে কাজে লাগানোর কৌশল মাত্র। জনপ্রিয় ম্যাচগুলো যখন অনুষ্ঠিত হয়, তখন সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা এমন নৃশংস গণহত্যা চালায়। এর ফলে মার্কিনিদের চোখ এড়িয়ে যায়, কীভাবে তাদের করের টাকায় শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। যখন সবাই খেলার মাঠে দলের জন্য উল্লাস করছে, তখন তাদের সরকার অস্ত্র সরবরাহ করছে, যা ফিলিস্তিনি বাড়িগুলোকে গণকবরে পরিণত করছে। রোমানরা একে বলত ‘রুটি ও সার্কাস’-জনগণকে খাওয়াও এবং বিনোদন দাও, যাতে তারা অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারে। এমনকি তা লক্ষও না করে। সুপার বোল হলো আধুনিক আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ সার্কাস, যা আমাদের জাতি যে নৃশংসতায় তহবিল দিচ্ছে, তা থেকে দক্ষতার সঙ্গে নজর সরিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু গেল রোববার রাতের প্রতিবাদের মতো মুহূর্তগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে, সবাই বিভ্রান্ত হতে প্রস্তুত নয়। ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারিতেও এমন প্রতিবাদ হতে দেখা গেছে, যখন ফিলিস্তিনিদের গণহত্যায় ইসরাইলকে মার্কিন সহায়তার অবসানের দাবিতে চার লাখেরও বেশি মানুষ ওয়াশিংটন ডিসিতে জড়ো হয়েছিল। এটি ছিল এক নজিরবিহীন গণসমাবেশ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশের রাজধানীতে এমন ঐতিহাসিক জনসমাবেশ হলেও মিডিয়া একে কাভার করেনি। যদি অন্য কোনো কারণে চার লাখ মানুষ জড়ো হতো, তবে তা সন্ধ্যার খবরের শিরোনামে থাকত, সামাজিক মিডিয়া দখল করত এবং পরের সকালে শিরোনাম ভরিয়ে দিত। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কারণে হওয়ায় এমন নীরবতা।
এটি কোনো ভুল ছিল না। এটি ছিল ফিলিস্তিনের মুক্তির দাবিতে ওঠা কণ্ঠস্বর দমনের একটি ইচ্ছাকৃত চেষ্টা মাত্র। ফিলিস্তিনিদের সর্বদাই বিশ্বের নজর কাড়ার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। যখন তাদের কণ্ঠস্বর মূলধারার গণমাধ্যম থেকে বাধা পেয়েছে, তখন তারা সামাজিকমাধ্যমে এগুলো প্রকাশ করেছে। যখন তাদের এ প্রতিবাদও উপেক্ষা করা হয়েছে, তখন তারা আরও বড় আয়োজন করেছে। এভাবে তারা নিজেদের অকৃত্রিম করে তুলেছে। সুদানের গল্পও অনেক দিক থেকে একইরকম, তবে এর নিজস্ব কিছু অনন্য দিক রয়েছে। যদি ফিলিস্তিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে সেন্সর করা হয়, তবে সুদানকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়। সুদানের মানুষ যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েছে, যা তাদের দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কল্পনাতীত যুদ্ধাপরাধের প্রায় সবই সুদানের জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে। হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ জোরপূর্বক স্থানচ্যুত হয়েছে, পুরো গ্রাম পুড়ে গেছে এবং দুর্ভিক্ষ আসন্ন। তবুও পশ্চিমা মিডিয়ায় সুদান প্রায় এক ফুটনোটের মতো রয়ে গেছে।
সুদানের মানবাধিকার কর্মীরা #EyesOnSudan হ্যাশট্যাগ দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, বিশ্বকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য এটা তাদের একটি মরিয়া আবেদন। তবে তাদের কান্না ফিলিস্তিনিদের মতোই বধির নীরবতায় নিমজ্জিত হয়েছে। সুদানের ওপর মিডিয়ার অন্ধত্ব শুধু অবহেলা নয়; এটি একটি পুরো জনগোষ্ঠীকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে সহযোগিতা মাত্র।
তবে মনে রাখা দরকার, মূলধারা যতই সুদানি ও ফিলিস্তিনের দুর্ভোগ মুছে ফেলার চেষ্টা করুক না কেন, সত্য প্রকাশ পাবেই। যেখানে শত শত, হাজার হাজার মানুষ ফিলিস্তিনের জন্য মিছিল করে চলেছে, গ্রেফতার কিংবা কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও।
আল জাজিরা থেকে অনূদিত
ড. ওমর সুলেমান : অধ্যাপক, সাউদার্ন মেথোডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়