বিশ্বকে সিরিয়ার পুনর্গঠনে একজোট হতে হবে

ড. মাজিদ রাফিজাদেহ
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67abc5513a158.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
প্রায় ১৪ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংঘাতের পর সিরিয়া একটি উল্লেখযোগ্য ও আশাব্যঞ্জক পরিবর্তনের সাক্ষী হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি তাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এটি সিরিয়ার পুনরুদ্ধারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এখন একটি নিরাপদ ও টেকসই প্রক্রিয়া সহজতর করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রায় ২ লাখ শরণার্থী ইসরাইল-হিজবুল্লাহ সংঘাতের পর লেবানন থেকে সিরিয়ায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রায় ৬ লাখ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত সিরিয়ানও বাশার আসাদের শাসনের পতনের পর তাদের পূর্ববর্তী গোষ্ঠীতে পুনর্বাসিত হয়েছে। যদিও এতে তাদের জীবনে পুনর্গঠনের আশার প্রতিফলন ঘটছে, তবে বাধাগুলো বিশাল এবং বাস্তবতা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।
সিরিয়ার অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত, স্বাস্থ্যসেবা এবং আবাসনের মতো মৌলিক চাহিদা অপ্রতুল এবং দারিদ্র্য ব্যাপক। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি পরিষেবা পুনরুদ্ধার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রদান এবং ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই মৌলিক উন্নতি ছাড়া বাস্তুচ্যুতির চক্র অব্যাহত থাকবে, যা দীর্ঘমেয়াদি পুনরুদ্ধারের বিষয়টিকে আরও কঠিন করে তুলবে জনগণ ও রাষ্ট্র উভয়ের জন্য। একটি নিরাপদ, বাসযোগ্য পরিবেশ প্রতিষ্ঠা কেবল নৈতিক কারণেই নয়, বাস্তব কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা এবং অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে ফিরে আসা শরণার্থীরা আবারও চলে যেতে বাধ্য হতে পারেন, যা ব্যক্তি পর্যায়ে পুনরুদ্ধার এবং জাতীয় পুনর্নির্মাণ প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
সিরিয়া পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাধা হলো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, যা দেশটির রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও রয়ে গেছে। এটি সিরিয়ার অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে, দেশটিকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং পুনর্গঠনের প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে। নিষেধাজ্ঞাগুলো সিরিয়ানদের আর্থিক লেনদেন পরিচালনা করতে, অনেক পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস রেমিট্যান্সের অর্থ পেতে এবং প্রয়োজনীয় পণ্য, চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহ এবং খাদ্য আমদানিতে সমস্যা সৃষ্টি করছে। এর ফলে পণ্যের ঘাটতি এবং মূল্যবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে, যা সিরিয়ানদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, যাদের মধ্যে রয়েছে উপসাগরীয় দেশগুলো এবং বিশেষ করে সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে পুনর্গঠন ও স্থিতিশীলতা সহজতর হয়। এটি অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি এবং প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোর প্রবেশাধিকার বাড়িয়ে আরও শরণার্থীকে ফিরে আসায় উৎসাহিত করবে।
অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থের প্রয়োজন, যার মধ্যে ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল এবং ইউটিলিটি অন্তর্ভুক্ত। প্রয়োজনীয় পরিষেবা পুনরুদ্ধার এবং কর্মসংস্থান তৈরি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়াবে। সিরিয়ার ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলোর পুনর্নির্মাণে যথাযথ বিনিয়োগ না হলে ফিরে আসা শরণার্থীরা বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতেই রয়ে যাবে। বড় আকারের পুনর্গঠন প্রকল্পগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা এবং আঞ্চলিক অংশীদারদের একটি সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
শাসন, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলোতে দক্ষতা বৃদ্ধি করে সিরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা যেতে পারে এবং এটি নাগরিকদের পরিষেবা ব্যবস্থার উন্নতি করতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো স্থানীয় শাসনতান্ত্রিক কাঠামোগুলোকে সমর্থন করতে পারে। জনসাধারণের পরিষেবাগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পারে এবং সমাজ পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারে। সরকারি কর্মচারী, স্বাস্থ্যসেবা পেশাজীবী এবং শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা এবং তাদের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, হতে পারে সেটা আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে, নিশ্চিত করতে পারে প্রত্যাবর্তনকারীদের পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদানের বিষয়টি।
এছাড়াও বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা হলে তা সিরিয়ার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, বিভিন্ন সুযোগ তৈরি করতে পারে এবং সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে। বাণিজ্যিক চ্যানেলগুলো পুনরায় খোলা এবং ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করে সিরিয়াকে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। সিরিয়ার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতি প্রচেষ্টার উদ্যোগ টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে। এছাড়াও স্থানীয় উদ্যোক্তা এবং ছোট ব্যবসাগুলোকে উৎসাহিত করে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
সমঝোতা ও সামাজিক সংহতি সৃষ্টিকারী বিভিন্ন উদ্যোগ সংঘাতের কারণে সৃষ্ট সিরিয়ানদের দীর্ঘকালের বিভাজন দূর করতে পারে; তাদের মধ্যে ঐক্য এবং অভিন্ন উদ্দেশ্যের অনুভূতি তৈরি করতে পারে। সামাজিক বিভাজনের শেকড় গভীরে রয়ে গেছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা গেলে তা ভবিষ্যতে সংঘাত এড়াতে সহায়তা করতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তিতে অবদান রাখতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সংহতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সিরিয়ার পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা কেবল সিরিয়ানদের জন্যই নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও সুফল বয়ে আনবে। সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা আঞ্চলিক নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে, শরণার্থী গ্রহণকারী প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর বোঝা কমাতে পারে এবং অনিয়মিত অভিবাসনজনিত সমস্যাগুলো হ্রাস করতে পারে। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় লাভবান হবে এমন একটি সিরিয়া থেকে, যা আবারও বৈশ্বিক পরিবারের একটি সমৃদ্ধ সদস্য হয়ে উঠবে।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তরিত
ড. মাজিদ রাফিজাদেহ : হার্ভার্ড-শিক্ষিত ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী