বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ কী
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
জোসেফ এস নাই
প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ কী](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/07/ezgif-7c731df6c529d-67a545dc299fd.jpg)
জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার সময় দেশটির ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিক হিসাবে পরিচিত অ্যালেক্স জোন্স তার এক্স (টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করেছিলেন, তারা ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালানো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শিল্পায়নমুক্ত করার এক বিশ্বায়নবাদী চক্রান্তের অংশ ছিলেন।’ যদিও জোন্সের ক্ষয়ক্ষতির ধারণাটি অযৌক্তিক ছিল, তবে তিনি ঠিকই বলেছিলেন যে, এ আগুনের সঙ্গে বিশ্বায়নের কিছু সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৩ সালে হওয়া এক পরিসংখ্যান বলছে, এর আগের বছরটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম এবং সম্ভবত তা কমপক্ষে ১ লাখ ২৫ হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম। প্রথমবারের মতো যা প্যারিস জলবায়ুচুক্তি মোতাবেক বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পস্তরের লক্ষ্যমাত্রার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে অতিক্রম করেছে। এর জন্য বিজ্ঞানীরা মানুষের দ্বারা সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনকে ব্যাপকভাবে দায়ী করেন।
বিশ্বায়ন বলতে আন্তঃমহাদেশীয় দূরত্বে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে বোঝায়। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য আঞ্চলিক আন্তঃনির্ভরতাকে প্রতিফলিত করে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্য বিশ্বায়নের প্রতিফলন ঘটায়। চীনের ওপর শুল্কারোপের হুমকি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমাদের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতার দিকটি খাটো করার চেষ্টা করছেন, যেটিকে তিনি দেশীয় শিল্প ও চাকরি হারানোর জন্য দায়ী করেছেন।
অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে, সেই ক্ষতির কতটা আসলে বিশ্ব বাণিজ্যের কারণে হয়েছিল। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশি প্রতিযোগিতার কারণে লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন বটে, তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়। অনেক অর্থনীতিবিদ এটাও যুক্তি দেন, অটোমেশনের বিষয়টি ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের পরিবর্তন সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে; কিন্তু এটি অর্থনৈতিক যন্ত্রণাও সৃষ্টি করে। তারা অভিবাসীদেরও দোষারোপ করেন, যদিও তারা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে। আফ্রিকার মানুষের অভিবাসন যুক্তিযুক্তভাবে বিশ্বায়নের প্রথম উদাহরণ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য অনেক দেশই একই মৌলিক ঘটনার ফলাফল। কিন্তু এ দেশগুলো তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী অভিবাসীরা প্রায়ই নতুনদের অর্থনৈতিক বোঝা ও সংস্কৃতির জন্য হুমকি বলে অভিযোগ তুলতেন, যে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে।
যখন অভিবাসন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে জনতাবাদীদের জন্য ক্ষমতাসীন সরকারকে অভিবাসন প্রসঙ্গে চ্যালেঞ্জ করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ট্রাম্পের ২০১৬ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনি প্রচারণায় এ বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। এ কারণেই কিছু মানুষ বিশ্বায়নের দ্রুত বিস্তারের অন্তরায়ের জন্য জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াকে দায়ী করে। তারা বলেন, কেন পপুলিস্টরা তাদের দেশের বেশির ভাগ সমস্যার জন্য বাণিজ্য এবং অভিবাসীদের দোষ দেয়।
স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্য ও অভিবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছিল। এর কারণ ছিল রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং উন্নত ও বৃহত্তর যোগাযোগ প্রযুক্তি, যা অর্থনৈতিক উন্মুক্ততার দিকে পরিচালিত করেছিল। এতে মূলধন, পণ্য ও মানুষের আন্তঃসীমান্ত প্রবাহের ব্যয় হ্রাস পেয়েছিল। এখন, জাতীয়তাবাদীদের প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর বৃদ্ধি ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের মতো সিদ্ধান্ত এ প্রবাহকে হ্রাস করতে পারে; কিন্তু অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন কি তা পালটাতে পারে? এর আগেও এমন হয়েছে। উনিশ শতকে বাণিজ্য ও অভিবাসন উভয়ই দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল; কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা থেমেও যায়। কিন্তু কয়েক দশক ধরে বাণিজ্য ও মোট বৈশ্বিক উৎপাদনের পরিমাণ ১৯১৪ সালের স্তরে ফিরে আসেনি।
এখন কিছু মার্কিন রাজনীতিক যখন চীন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে সওয়াল করছেন, তখন কি এটি আবার ঘটতে পারে? যদিও নিরাপত্তার উদ্বেগের কারণে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হ্রাস পেতে পারে, তবে প্রতিবছর অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের সম্পর্ক পরিত্যাগ করা সহজ কথা নয়। যেমন, ‘অসম্ভব’ আর ‘অবাস্তব’ এক কথা নয়। উদাহরণস্বরূপ, তাইওয়ান নিয়ে দ্বন্দ্ব মার্কিন-চীন বাণিজ্যকে ধ্বংস করতে পারে। যাই হোক না কেন, বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ বোঝার জন্য আমাদের অর্থনীতির বাইরেও তাকাতে হবে। বৈশ্বিক আন্তঃনির্ভরতার আরও অনেক প্রকার রয়েছে। যেমন-সামরিক, পরিবেশ, সমাজ, স্বাস্থ্য ইত্যাদি। যদিও যুদ্ধ সর্বদা সরাসরি জড়িতদের জন্য বিধ্বংসী; তবে এটি মনে রাখা উচিত, করোনা মহামারি এসব যুদ্ধের চেয়ে বেশি মার্কিনিকে মেরে ফেলেছে। একইভাবে, বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জন্য প্রচুর খরচের সম্মুখীন করবে। কারণ, উষ্ণায়নের কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ আরও গলে যাবে এবং শতাব্দীর শেষদিকে উপকূলীয় শহরগুলো সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ডুবে যাবে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন হারিকেন ও দাবানলের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিমাণ ও তীব্রতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। এমন এক পরিস্থিতিতে ট্রাম্প ক্ষমতা নিয়েই কিনা প্যারিস চুক্তি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে তার দেশকে সরিয়ে নিলেন।
এ অবস্থায় বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ কী? দীর্ঘ দূরত্বের আন্তঃনির্ভরতা জীবনের একটি সত্য হিসাবে থাকবে, যতক্ষণ মানুষ যোগাযোগ ও পরিবহণ প্রযুক্তিতে সচল ও সজ্জিত থাকবে। সর্বোপরি, বৈশ্বিক অর্থনীতি বহু শতাব্দীর পুরোনো, এর শিকড় সিল্ক রোডের মতো প্রাচীন বাণিজ্য পথ পর্যন্ত প্রসারিত (যা চীন আজ তার বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ পরিকাঠামো বিনিয়োগ কর্মসূচির স্লোগান হিসাবে গ্রহণ করেছে)।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে সমুদ্রগামী পরিবহণের উদ্ভাবন অনুসন্ধানের যুগ নিয়ে আসে, যার পর ইউরোপীয় উপনিবেশের যুগ আসে, যা আজকের জাতীয় সীমানা গঠন করেছে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের জাহাজ এবং টেলিগ্রাফ এ প্রক্রিয়াটিকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল; কারণ, শিল্পায়ন কৃষি অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করেছিল। এখন তথ্য বিপ্লব আমাদের অর্থনীতিকে পরিষেবা ভিত্তিতে রূপান্তরিত করছে।
ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার এ শতাব্দীর শুরুতে শুরু হয়েছিল এবং বিশ্বজুড়ে এখন কোটি কোটি মানুষ তাদের পকেটে একটি কম্পিউটার বহন করেন। এআই’র অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক যোগাযোগের সুযোগ, গতি ও পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে বিপরীতমুখী করেছিল। সংরক্ষণবাদী নীতিগুলো এটিকে আরও স্থবির করে দিতে পারে। এখনকার বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি; কিন্তু যতদিন আমাদের কাছে প্রযুক্তি থাকবে, ততদিন বিশ্বায়ন অব্যাহত থাকবে, এটি উপকারী না হলেও।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনূদিত
জোসেফ এস নাই : ইমেরিটাস অধ্যাপক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র