Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রজত জয়ন্তী উৎসবে যুগান্তর

যুগান্তরের জীবদ্দশায় অর্থনীতির হালচাল

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যুগান্তরের জীবদ্দশায় অর্থনীতির হালচাল

ড. আর এম দেবনাথ।

আজ যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দেখতে দেখতে যুগান্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে ২৫ বছর কাটিয়ে দিল। এ সময় যুগান্তরেরই শুধু পরিবর্তন হয়নি, বাংলাদেশেরও সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এর মধ্যে ভালো-মন্দ সবই আছে। প্রথমেই যে বড় গুণগত পরিবর্তনটি নজরে পড়ে, তা হচ্ছে ‘গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাকটের’ (জিডিপি) গুণগত পরিবর্তন। আকার ও প্রকারের পরিবর্তন। আমাদের জিডিপি ছিল কৃষিনির্ভর। এটা এখন আর নেই। স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে যুগান্তর প্রকাশের পর থেকে আমাদের জিডিপি ধীরে ধীরে শিল্প ও সেবাভিত্তিক হয়ে উঠেছে। সেবাই এখন আমাদের জিডিপির শতকরা ৫০ ভাগ। ২৮-৩০ শতাংশের মতো এখন ছোট-বড় শিল্প। কৃষি পেছনে পড়ে গেছে। শতাংশের হিসাবে তা কিন্তু অসংগঠিত খাতে কর্মসংস্থানের দিক থেকে এখনো এক নম্বরে। আর সংগঠিত খাতের হিসাবে শিল্প খাত এখন কর্মসংস্থানে এক নম্বর। অবশ্য তা তৈরি পোশাক খাতসহ। বিশাল এক কর্মীবাহিনী আজ শিল্প খাতে কাজ করে। হাজার হাজার শিল্পকারখানা। তৈরি পোশাক বাদে আমাদের ভালো শিল্প খাত হিসাবে আছে ওষুধশিল্প, ইস্পাত, সিমেন্ট, লোহা-রড, আসবাবপত্র, আবাসন, চিনি, আইটি ইত্যাদি। উল্লেখ করার মতোই।

বলাই বাহুল্য, শিল্প খাতের মধ্যে আবার ‘অসংগঠিত’ খাত আছে। এর মধ্যে পড়ে কয়েক লাখ ছোট ছোট কারখানা। এখানে কাজ করে কোটিখানেক লোক। এর সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছে এক নতুন শ্রেণি, যারা উচ্চাভিলাষী। এ উত্থানে আমাদের পাট পেছনে পড়ে গেছে, চা-ও পেছনে পড়ে গেছে। সামনে এসেছে ধান-চালের উৎপাদন। স্বাধীনতার পর বিশেষ করে বিগত ২৫ বছরে ধান-চালের উৎপাদন বেড়েছে চারগুণেরও বেশি। মাছের উৎপাদন, রকমারি ফলের উৎপাদন বেড়েছে। অনেক কৃষক এখন ধানচাষ বাদ দিয়ে ফল-ফলাদি, মাছ উৎপাদন করে তাদের আয় বাড়িয়ে নিচ্ছে। কৃষির এ উত্থান শুরু আগে থেকেই। শেষের ২৫ বছরে তা সবার নজরে এসেছে। এখন খাদ্যের ঘাটতি আছে, খাদ্যাভাব নেই। ‘মঙ্গা’ নেই। উত্তরবঙ্গ শস্যে ভরপুর। কুষ্টিয়া ইত্যাদি অঞ্চল এখন ধান-চালের অঞ্চল। তবে কথা থেকেই যায়। এত চেষ্টার পরও আমাদের গমের ঘাটতি বছরে ৫০-৬০-৭০ লাখ টন। চাল ৫-১০ লাখ টন। অবশ্য খাদ্যাভাবে লোক উপোস যায় না। এ পরিবর্তনটুকু আমরা গত ২৫ বছর ধরে দেখতে পাচ্ছি।

এদিকে খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। মোটা চালের চাহিদা কমছে। চিকন চালের বাড়ছে। মানুষ চা-কফি খাচ্ছে। আগে এসবের চল ছিল না। মাংস খাচ্ছে লোকে। শুধু রোগীই নয়, সাধারণ মানুষও ফল খাচ্ছে। কিন্তু বড় প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। এখনো ২০-২৫ শতাংশ লোক তিনবেলা ভাত পায় না। আবার পরিমিত খাবারের অভাবে শিশুদের ওজন কম। অপুষ্টিতে ভুগছে সারা দেশ। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে। তবে সার্বিকভাবে কৃষি খাত ভালো করছে, যদিও উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। কৃষিকে কেন্দ্র করে বিগত ২৫ বছরে বহু শিল্প গড়ে উঠেছে গ্রামে। গ্রামাঞ্চলে কনট্রাক্ট ফার্মিং হচ্ছে। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। রেমিট্যান্সের প্রভাবে গ্রামে কর্মবিমুখ লোক তৈরি হচ্ছে।

শুধু জিডিপির আকার-প্রকার ও গুণগত মানের পরিবর্তন নয়, পাশাপাশি বেড়েছে আমাদের আমদানি-রপ্তানি। আগে আমরা রপ্তানি করতাম ‘মিলিয়ন’ (দশ লাখ) হিসাবে। এখন রপ্তানি ও আমদানি হিসাব হয় বিলিয়ন ডলারে (শতকোটি)। রপ্তানি পণ্য হিসাবে ছিল পাট-পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া-চামড়াজাত দ্রব্য। এখন আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক। ২৫ বছরে এর পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু এর মধ্যে কোনো বৈচিত্র্য আসেনি। না বাজারে, না পণ্যে। বাজার হচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপ। আর পণ্য জামা-কাপড়। লাভের লাভ এ খাতে ৩০-৪০ লাখ কর্মী কাজ করে। ইদানীং অবশ্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ফলে কর্মসংস্থান এ খাতে কমছে।

আমদানির চিত্রটি কোনোমতেই ভালো নয়। চাল, ডাল, লবণ, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, সয়াবিন, শাকসবজি, কাঁচা মরিচ, আলু ইত্যাদিও আমাদের আমদানি করতে হয়। তার মানে আমরা হয়ে পড়েছি আমদানিনির্ভর দেশ। এটা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। আমদানি ব্যবসাটা আবার হয়ে পড়েছে অর্থ পাচারের মাধ্যম। বিগত ২৫ বছরে অর্থনীতি বড় হয়েছে, এর সঙ্গে আমদানি হয়েছে রপ্তানির চেয়ে বেশি। এর ফাঁকে ঢুকে পড়েছে আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং, যা আমাদের অর্থনীতিতে ক্ষত সৃষ্টি করছে। আমদানি-রপ্তানিতে গত ২৫ বছরে বড় হয়েছে আমাদের রেমিট্যান্স খাত। জনশক্তি রপ্তানির পরিমাণ বেশ বেড়েছে। বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি হচ্ছে প্রবাসী আয়, যা গ্রামীণ সমাজকে উজ্জীবিত রেখেছে, উপকৃত প্রায় ১ কোটি পরিবার।

রপ্তানি আয়ের কথা বললে বরং প্রবাসী আয়ই আমার মতে এক নম্বর। রপ্তানি আয় যা দেখানো হয়, তা থেকে বাদ যাবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আমদানি। প্রকৃত মূল্য সংযোজন এখানে রপ্তানির ৪০-৫০-এর বেশি হবে বলে মনে হয় না। দেশে বিগত ২৫ বছরে গড়ে উঠেছে বড় বড় অবকাঠামো-এক্সপ্রেসওয়ে, লং রোড, ওভারব্রিজ, পদ্মা ব্রিজ, কর্ণফুলী সেতু ইত্যাদি। এসব খুবই ‘কস্টলি প্রজেক্ট’, যা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। তবে মেট্রো রেলের মতো প্রকল্পে জনগণের উপকার হয়েছে।

এসব উন্নয়ন যা সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে যোগ হতে পারে মধ্যবিত্তের বিকাশ। মধ্যবিত্ত বলতে ‘পরিণত’ মধ্যবিত্তের কথা বলছি না। বিত্তের দিক থেকে একটা মধ্যবিত্ত তৈরি হয়েছে। তা হবে ২০-৩০ শতাংশ। বিরাট নির্বাহী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। উকিল, ডাক্তার, পেশাজীবী, অ্যাকাউন্টেন্ট, অডিটর, ব্যাংকার, বিমাবিদ, শিক্ষক প্রভৃতি শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। তারাই বাজারের ক্রেতা। তারাই দুপুর-রাতে হোটেলে খায়। বড় বড় হাসপাতালে যায়। দেশে হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বাড়ছে। এসবই মধ্যবিত্তের জায়গা। তারাই আবাসন শিল্পের ক্রেতা। বিনোদনের ভোক্তাও তারাই। বিগত ২৫ বছরে ঢাকা শহরের চারপাশে গড়ে উঠেছে অনেক অবকাশকেন্দ্র। সমাজের পরিবর্তন লক্ষণীয়। লোকে জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করায় বড় বড় হাসপাতালে। অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে জমির দাম বেড়েছে বহুগুণ। মধ্যবিত্তের একাংশ চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। সবকিছু বিক্রি করে। ২৫ বছরের উন্নয়নের নিট ফল দেখা যাচ্ছে এটাই।

তবে এ কথা বলতেই হয়, এত সুখ আমাদের বেশিদিন থাকেনি। মাঝপথে প্রথম একটা ধাক্কা আমরা খেলাম ২০১৯-এর দিকে। করোনার সময়। অর্থনীতিতে ধস নামে। সারা বিশ্বে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। আমাদের দেশও বাদ যায়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদানের মাধ্যমে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হয়। গরিবকে বাঁচানো হয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪-৫ শতাংশে নেমে আসে ৬-৭ শতাংশ থেকে। এ ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আসে আরও বড় ধাক্কা। একদম শেষ করে দেওয়ার মতো অবস্থা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের একদম মৃতপ্রায় করে দেয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসের দাম বাড়ে। তেলের দাম বাড়ে। ডলারের রিজার্ভ কমে যায়। ডলারের দাম বেড়ে যায়। ৮৬ টাকা থেকে ডলারের দাম এখন ১২০-১৩০ টাকা। মূল্যস্ফীতি আজ ৪ বছর ধরে ৮-১০ শতাংশ। কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে হয়। বহু শর্ত। তেলের দাম বাড়াতে হবে, ভর্তুকি কমাতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। এর অর্থ, মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার আশঙ্কা সামনে।

রাজস্ব নেই। খরচের কমতি নেই। সরকার সমানে ভ্যাটের আওতা বাড়াচ্ছে। আর বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। সাধারণের মানুষের পক্ষে বাজারে যাওয়ার পথ নেই। ব্যাংকে টাকা নেই। বেসরকারি ঋণ নেই। বিনিয়োগ নেই। বিদেশি ঋণ পাওয়া যায় না। সরকার তার দেনা পরিশোধ করতে পারছে না। ডিম, আলু, আমদানি করতে গিয়ে আমরা নাস্তানাবুদ। ঋণের ওপর সুদ অত্যধিক বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। ১২-১৩ শতাংশ সুদ দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয় বলে মত দিচ্ছেন তারা। এদিকে আমদানিকারকদের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। দেশের ভেতরের ঋণ, বিদেশি ঋণের ওপর সুদ দিনদিন বাড়ছে। ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অথচ ডলারের রিজার্ভ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না। আমদানি নিয়ন্ত্রণ চলছে। আমদানির জন্য ডলার নেই। ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। ফলে বাজারে পণ্যের অভাব। এর মধ্যে আবার এসে গেছে পবিত্র ঈদ।

এই হচ্ছে ২৫ বছরের ইতিহাস। উত্থান, উন্নয়ন। তারপর করোনার ধাক্কা। দ্বিতীয় ধাক্কা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের। ২০২৫-এ আমেরিকায় বিরাট পরিবর্তন। এসেছেন ট্রাম্প, ক্ষমতায় যিনি সবকিছুর পরিবর্তন করতে চান। পরিশেষে যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা রইল।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম