Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শিক্ষা সমাজ দেশ

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ থেকে বহুত্ববাদ

Icon

ড. হাসনান আহমেদ

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ থেকে বহুত্ববাদ

প্রতীকী ছবি

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে এ পত্রিকায় ও বিভিন্ন বইয়ে অনেক লেখালেখি করেছি; এখানে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বলি। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলতে গেলেই এদেশের বেশকিছু আঁতেল পুরোনো অপ্রয়োজনীয় ইতিহাস টেনে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চান। সে ইতিহাসও আমাদের জানা। ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দের বাংলা এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ করা হয়েছিল। সেক্যুলারিজম শব্দের অর্থ ও শব্দের উৎপত্তি দেখলে একে পার্থিববাদী, বস্তুবাদী অথবা দ্বীনপালনকারী নয় এমনকে বুঝি। বাংলায় ‘ধর্ম’ শব্দটা নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না। কারণ ধর্ম পালনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে। নইলে সাংবিধানিক বৈপরীত্য চোখে পড়ে। যত আপত্তি ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে। নিরপেক্ষতার আভিধানিক অর্থ পক্ষপাতশূন্যতা, অপক্ষপাত, স্বাতন্ত্র্য ইত্যাদি।

বাস্তব জীবনেও সে অর্থেই শব্দটা ব্যবহৃত হয়; যদিও খাতা-কলমে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে অহেতুক তর্ক করি। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মস্বাতন্ত্র্য, কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাত নয় এমন। কোনো ধার্মিক লোক কি ধর্মস্বতন্ত্র ও কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতশূন্য হতে পারে? নিজের ধর্মের প্রতি পক্ষপাত না হলে তিনি সে ধর্ম পালন করবেন কেন? তাই তাকে ধর্মের প্রতি পক্ষপাতশূন্য না হয়ে ‘ধর্ম-অহিংস’, ‘ধর্ম-বিদ্বেষহীন’ হতে বলতে পারি। এতে যার যার ধর্ম, সে সে পালন করলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়-তা কেউ ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম পালন করুক কিংবা না করুক। দীর্ঘদিন বিতর্কের পর এ দেশের সংবিধান থেকে সে শব্দগুচ্ছটি সম্ভবত বাদ যেতে চলেছে। ফলে তর্কেরও অবসান হবে বলে বিশ্বাস। এতে সব ধর্মের ধর্মভীরু লোকের স্বস্তি পাওয়ার কথা।

এ দেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দকে ‘বহুত্ববাদ’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাওয়া হচ্ছে। এটি আমাদের নতুন প্রস্তুতি। অনেক ধর্মহীন ব্যক্তির এতে আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ তাদের তো ধর্মেই বিশ্বাস নেই। কেউ কেউ ধর্মবিদ্বেষী। অনেক প্রাচীনকাল থেকেই পশ্চিমা সভ্যতাসহ ভারতীয় উপমহাদেশেও বহুত্ববাদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পশ্চিমা দেশে শব্দটি বহুলভাবে ব্যবহৃত। ছোটবেলায় গ্রাম-গঞ্জের বাজারে ওষুধ বিক্রেতা বা ক্যানভ্যাসারদের মুখে প্রথমেই বলতে শুনতাম, ‘এক দেশের বুলি, অন্য দেশের গালি’। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব শব্দটি কী অর্থে ব্যবহার করে তা আমরা অনেকেই জানি। সেখানকার কোনো শব্দের ব্যবহার ও সংস্কৃতি এবং ভারত উপমহাদেশের সংস্কৃতি কিন্তু এক নয়। সেমতে বহুত্ববাদ শব্দটি এ উপমহাদেশে বিভিন্ন দর্শন ও তত্ত্ব আলোচনায় বিভিন্নরূপ ধারণ করে। এর কারণও আছে। হিন্দুত্ববাদী আস্তিক্য অথচ পুনর্জন্ম দর্শনের বাইরেও ভারতীয় দর্শনের অনেক ধারা রয়েছে, যেমন-বৌদ্ধ দর্শন, জৈন দর্শন, চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন প্রভৃতি। এর অনেকগুলোর মধ্যে ভারতীয় বস্তুবাদী চেতনার আত্মপ্রকাশ করেছে। হিন্দুত্ববাদ আস্তিক্য দর্শন হলেও সেমেটিক দর্শন, যেমন-ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলামের মতো ধর্মের যেমন একটি করে ধর্মগ্রন্থ আছে-ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট ও কুরআন; সেভাবে হিন্দু ধর্মের কোনো একটি মূল ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যায় না। তাছাড়া পুরাকাল থেকেই হিন্দুত্ব দর্শন নানাত্বধর্মী, এর অনেক চিন্তা-চেতনা; বহুত্ববাদী দেব-দেবতার অস্তিত্ব ও উপাসনা এবং সেই পুরাকাল থেকেই ভারতীয় সমাজ সাম্প্রদায়িক দুষ্টচক্রে আবর্তিত। হিন্দু ধর্মে দ্বৈতবাদের অস্তিত্বও পরিলক্ষিত হয়। সেদিক বিবেচনায় হিন্দু ধর্ম বৈচিত্র্যময়। তবে মূলত ভারতীয় সমাজের প্রাণ হচ্ছে বহুত্ববাদ, যদিও তারা আক্ষরিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে ব্যবহার করে আসছে। সে অর্থে বস্তুবাদ ও ভোগবাদও তো বহুত্ববাদের উদাহরণ। আমার প্রশ্ন, একত্ববাদী মুসলমানরা কি বহুত্ববাদের নীতিতে বস্তুবাদ ও ভোগবাদকে মেনে নেবেন, যেভাবে পশ্চিমা রাষ্ট্রচিন্তায় খ্রিষ্টান ধর্মযাজকরা বহুত্ববাদের ধারণাকে তাদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন এবং গ্রহণ করেন না?

বহুত্ববাদকে বিভিন্ন দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করা হয়, যেমন-ক্ষমতার বহুত্ববাদ, অভিজাত বহুত্ববাদ, নব্য বহুত্ববাদ; এছাড়াও বহুত্ববাদ তত্ত্বের নানামুখী বিশ্লেষণ আছে-সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ, দার্শনিক বহুত্ববাদ, ধর্মীয় বহুত্ববাদ, সমাজিক বহুত্ববাদ প্রভৃতি। ‘সমাজতত্ত্বে বহুত্ববাদের অর্থ হলো বহুসংস্কৃতির উপস্থিতি, বহুত্ববাদ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে স্বীকার করে এবং একত্ববাদের বিরোধী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং বহু গোষ্ঠীবিশিষ্ট সমাজে বহু সংস্কৃতির অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।’ পশ্চিমা বিশ্বে সামাজিক বহুত্ববাদ স্বাধীনভাবে মেলামেশার সুযোগ দেয়। সেজন্য বহুত্ববাদের নামে এদেশে ফ্রি-সেক্স, অবাধ মেলামেশা, লিভ টুগেদার, ট্রান্সজেন্ডার, শয়তানের পূজাকে অনুমতি দেওয়া হবে কিনা? আমার বিশ্বাস, ধর্মীয় রক্ষণশীল সমাজ এ দেশে বহুত্ববাদের নামে অপসংস্কৃতির প্রসার ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব কমপক্ষে ৯৯.৫০ শতাংশ ধার্মিক লোক মেনে নেবে না।

এক্ষেত্রে ধর্মীয় বহুত্ববাদ বিষয়টি একটু আলোচনার দাবি রাখে। ধর্মীয় বহুত্ববাদ হলো সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসের বৈচিত্র্য; যেখানে একটি সমাজের বা দেশের ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও ধর্মের স্বাধীনতাকে এবং সাম্প্রদায়িক সহনশীলতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাই ধর্মীয় বহুত্ববাদ বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুসারীদের মধ্যে আন্তরিক সহাবস্থানের ঐক্যতান সৃষ্টি করে। সেদিক বিবেচনায় সাংবিধানের মূল নীতিমালা সংশোধনের জন্য ‘বহুত্ববাদ’ শব্দটি বলবৎ রাখতে গেলে একশব্দের পরিবর্তে ‘ধর্মীয় বহুত্ববাদ’ শব্দযুগলের ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যথায় সব জটিলতা ও তত্ত্বকথাকে বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের বোধগম্য সরল-সোজা কথা ‘ধর্ম-সম্প্রদায় অহিংসা’ শব্দগুচ্ছের ব্যবহার সবচেয়ে নিরাপদ হতে পারে।

প্রকাশিত অনেক নিবন্ধে এবং সংবিধান সংস্কার কমিটির কাছে লিখিতভাবে জমা দিয়ে বলেছিলাম, এ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষার উন্নতির জন্য স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করার ব্যবস্থা পরিবর্তিত সংবিধানে রাখা অতীব প্রয়োজন। এছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিমূল, উদ্দেশ্য ও কাঠামো পরিবর্তনের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শুধু সিলেবাসের কয়েকটি অধ্যায় ও টেক্সট পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়। এ দেশের শাশ্বত সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে স্বকীয় সত্তা বজায় রেখে শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সময়ের দাবি। জানি, অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে সময় খুব কম। কিন্তু যে সময় হাতে আছে, এর মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষা একসূত্রে গেঁথে inclusive society এবং integrated education system-এর রূপরেখা ও শিক্ষাকাঠামো অন্তত দাঁড় করানো সম্ভব, যার গুরুত্ব এদেশের উন্নতি ও অস্তিত্ব রক্ষায় অন্য যে কোনো সংস্কারের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বিষয়টিকে সংশ্লিষ্ট মহল গুরুত্ব দেবে বলে আশাবাদী; নইলে সেই পূর্বোল্লিখিত গল্পের মতো ‘চাখাইতে চোখাইতে চরণো ধরিতে উঠে ঘাসো খেল হে’ অবস্থার পুনরাবৃত্তি হবে।

ড. হাসনান আহমেদ : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ

pathorekhahasnan.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম