Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

তারুণ্যের উৎসবে রসনাবিলাস

Icon

মোহাম্মদ রেজুয়ান খান

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তারুণ্যের উৎসবে রসনাবিলাস

দেশের মোট ভূখণ্ডের এক-দশমাংশ অঞ্চলজুড়ে আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের পরিবর্তনের চাকা ঘূর্ণনের মাতোয়ারায় উদ্যমী পাহাড়ি তরুণ জনতা। তারা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে পাহাড়ি-বাঙালি সুসম্পর্ক বজায় রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে চলেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিল তরুণ জনতা। বাংলাদেশের তরুণরা জেগেছিল, জেগে আছে এবং আবহমানকাল জেগে থাকবে। টগবগে এ তরুণ জনতা তারুণ্যের উৎসবে স্বাধীনতার সূর্যকে কখনো ম্লান হতে দেবে না, এ বিশ্বাস সবার। তারুণ্যের এ উৎসবে মেতেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনপদ।

‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’-সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এখন সবাই সরব। টগবগে পাহাড়ি তরুণ, যুবক ও জনতা তারুণ্যের উৎসবে দেশের উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় মিশে একাকার হওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। পাহাড়ি তরুণরা শুধু জুমচাষ আর পূজা-পার্বণ উৎসবেই সীমাবদ্ধ নয়; সম্প্রীতির বন্ধন, পার্বত্য অঞ্চলের সৌন্দর্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা এবং রাজধানীর পার্বত্য মেলা তাদের জীবনধারায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তারুণ্যের উৎসবের মাধ্যমে পাহাড়ি জনপদের একটুকরো অংশকে উপহার দিতে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার বেইলি রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে পার্বত্য মেলার আয়োজন করা হয়েছে। পাহাড়ি পণ্যসহ ৮০টির মতো স্টল থাকছে এবারের মেলায়। উৎসবমুখর পরিবেশে পার্বত্য মেলা ও তারুণ্যের উৎসব-২০২৫ উদযাপিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, ৩০ তারিখ সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অবিরাম মেলার কার্যক্রম চলবে। পাহাড়ি-বাঙালির মিলনমেলা এ মেলা। আপ্যায়নে পাহাড়ি খাবার মেন্যুতে থাকবে বৈচিত্র্য। এছাড়াও সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বাংলাদেশের খাদ্য সংস্কৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ। ভৌগোলিক গঠন এবং বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্য সংস্কৃতি আমাদের খাদ্যাভ্যাসকে করেছে সমৃদ্ধ। এর মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলের খাবার এক ব্যতিক্রমী খাদ্যভান্ডার হিসাবে দখল করে আছে। পার্বত্য অঞ্চলের খাবারে প্রকৃতির সান্নিধ্য এবং সহজলভ্য বিভিন্ন উপাদান পাহাড়ি খাদ্যভান্ডারকে সৃজনশীল করেছে। পাহাড়ি প্রকৃতি, আবহাওয়া, নদী-ঝরনা, লতাপাতার গুল্ম, শাকসবজি, ফল-ফলাদি, সবুজ বৃক্ষের সজীবতা এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণ এ অঞ্চলকে সমতল থেকে করেছে আলাদা।

পার্বত্য এলাকার মানুষ মাছ, মাংস, শাকসবজি, ফলমূল, শুঁটকি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক উপাদান মিশ্রিত মসলা দিয়ে পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যসম্মত এবং স্বাদে অতুলনীয় খাবার তৈরি করে থাকে। এ খাদ্যসম্ভার আমাদের মুগ্ধ করে এবং স্বাদের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

এবারের পার্বত্য মেলায় খাবার মেন্যুতে থাকছে জনপ্রিয় পাহাড়ি শাকসবজি, প্রাকৃতিক উপাদানের মসলা, মাছ, মাংস এবং কচি বাঁশ। সেদ্ধ কচি বাঁশ, বাঁশের ডাল, বাঁশ দিয়ে ছোট মাছ রান্না ও সবজির মিশ্রণে বাঁশ মেলায় রসনা বিলাসিতাকে বাড়িয়ে দেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের জন্য বাম্বু চিকেন একটি জনপ্রিয় খাবার। এটি মূলত আস্ত টুকরো করা বাঁশের মধ্যে মুরগির মাংস, হলুদ, কাঁচামরিচ, আদা, রসুন, ধনেপাতা, লবণ এবং অন্যান্য মসলার মিশ্রণ দিয়ে তৈরি করা হয়। পাহাড়ি চিকেন মসলার সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে বাঁশের মধ্যে ভরে অল্প আঁচে রান্না করা মাংসে চুলার ধোঁয়া এবং কাঠের গন্ধের মিশ্রণ মেলায় ক্রেতাদের রসনার স্বাদ বাড়িয়ে দেবে। উনুনের উপর থাকা অবস্থায় বাঁশের খোলস ফেটে গেলে সুস্বাদু মাংস বাঁশকোড়ল যে পুরোপুরি প্রস্তুত, তা বোঝা যাবে।

মেলায় সামুদ্রিক মাছের সিদল শুঁটকি, বিভিন্ন মসলা, শাকসবজি, বাঁধাকপি, লাউ, কুমড়ো, বরবটি, আলু ইত্যাদি রান্না করে পরিবেশন করা হবে। পাহাড়ের গোলআলু, মিক্স সবজি, হাঙর শুঁটকি বেগুন, কাঁঠাল, শিম দিয়ে রান্না করার স্বাদও অতুলনীয়। পাজন রান্না পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর আরেকটি ঐতিহ্যবাহী নিরামিষ খাবার। এ খাবারটি তৈরিতে বাঁধাকপি, মিষ্টিকুমড়ো, বরবটি, পুঁইশাক, মুলা ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। পাজন তৈরিতে অতিরিক্ত মসলা বা তেলের প্রয়োজন হয় না। পাহাড়ি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় এ খাবারটি এবারের মেলায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভাপ দিয়ে রান্না করা বা সেদ্ধ করা হেবাং খাবার মেলায় আগ্রহী ক্রেতাদের রসনার স্বাদ আরও বাড়িয়ে দেবে। এসব খাবারে অল্প তেলের ব্যবহার আর হরেকরকম উপাদানের মিশ্রণে খাবার থাকবে সতেজ ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। চিংড়ি, ছোটমাছ ও কাঁকড়া দিয়ে তৈরি শুঁটকিকে প্রসেস করে নাপ্পি খাবার তৈরি হয়, যা পাহাড়ি-বাঙালি উভয়েরই একটি জনপ্রিয় খাবার। ভালো করে মসলা মাখিয়ে ডিমের তৈরি হেবাং পাহাড়ি মেলার আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেবে। এছাড়া শামুকের ঝোল তো থাকছেই।

পার্বত্য মেলায় পাহাড়ি ব্যবস্থাপনায় বিশাল আয়োজনে রাজধানীবাসীসহ সবার জন্য থাকছে তুলসীমালা চালের চিকেন বিরিয়ানি। এর সুগন্ধি মেলায় আগতদের মাতোয়ারা করে তুলবে। সেই সঙ্গে থাকছে সান্নী পিঠা, কলা পিঠা, কালো বিন্নি চালের পিঠা, লাড্ডু, সিস্টেম, খাংময়, ব্যাম্পো সুট, ইজোর ইত্যাদি। সেদ্ধ শাক ভর্তা খাবারে পরিপূর্ণতা আনবে। ঢেঁকিশাক সেদ্ধ, ফুলকপি সেদ্ধ, সেদ্ধ শিম ইত্যাদির সঙ্গে মরিচ, সিদল শুঁটকি, ধনেপাতা, পেঁয়াজ, লবণ মিশ্রণে ভর্তা তৈরি করা থাকবে মেলায়। ভর্তাপ্রেমীদের শুঁটকি বড়া পিঠা, হলুদ ফুলের ভর্তা সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখবে। পাহাড়ি ফলের তুলনা হয় না। আম, কলা, পেঁপে, আনারস মেলার ভোজনরসিকদের রসনার আকর্ষণ বাড়াবেই। মেলায় আগত অতিথিদের আকর্ষণীয় করার জন্য থাকছে সুপেয় আখের রস।

এসব খাবারের পাশাপাশি মেলার স্টলগুলোতে সাজানো থাকবে ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি সংস্কৃতির বুননশিল্পের ছোট-বড় সবার জন্য নানা বাহারি পোশাক। নকশি করা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক, নিজস্ব ডিজাইন করা পোশাক, টেক্সটাইল পণ্য ও হস্তশিল্প পণ্যগুলো সব ধরনের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করবে। ক্রেতারা সেখানে সাধ্যমতো তাদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারবেন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যাদের খাদ্যে অ্যালার্জি, উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে, তারা ডাক্তারের পরামর্শমতে জেনে-বুঝে পার্বত্য মেলার রসনা বিলাসিতায় অংশ নেবেন। পাহাড়ি এ ধরনের খাবারে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়া পার্বত্য এলাকার মানুষগুলো অভ্যস্ত। প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি এসব খাবার সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। পাহাড়ি এসব খাবার রসনাবিলাসের পরিপূর্ণতা দেবে। বৈচিত্র্যময় মেলাটি তারুণ্যের উৎসবে পরিণত হবে।

মোহাম্মদ রেজুয়ান খান : তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম