Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ : সংস্কার

Icon

সাঈদ খান

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রসঙ্গ : সংস্কার

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সাধারণত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি অস্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত।

এটি সাধারণত দেশের রাজনৈতিক সংকটে গঠিত হয়। এ সরকারের মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, শান্তিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক কাজ চালিয়ে যাওয়া। এ ছাড়া, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় রাখা, সহিংসতা প্রতিরোধ করা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল-স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান, সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈষম্য নিরসন, ভোটাধিকারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি, ঘুস, চাঁদা, হত্যা-খুন-ধর্ষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করা। যে কারণে একটি সাধারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলেও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব কিছুটা বেড়ে যায়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য সর্বত্র ‘সংস্কার’ দরকার-এ স্লোগান দিয়ে হতভাগা জাতির মনে আশা জাগায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

কিন্তু শুরু থেকে গণ-অভ্যুত্থানে নিহত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও আহতদের সুচিকিৎসা করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও সে কাজে পুরোপুরি সফল হয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস পরেও নিহত-আহতদের পরিবার যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায়নি। দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত অধিকাংশ আসামিকে গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে পারেনি। দীর্ঘ পনের বছর সাত মাসের হত্যা-খুন-ধর্ষণ, লুটপাট, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে সক্ষম হননি। অন্যদিকে দুর্নীতি, ঘুস, চাঁদা, হত্যা-খুন-ধর্ষণ-সবই চলছে সমান তালে, যদিও এ সরকারের দশ ভাগ সফলতাও আছে। তাহলে এ নব্বই ভাগ ব্যর্থতার দায় কার?

আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা গ্রেফতার হলো না। অলিগার্কদের আটকানো গেল না। তাদের বিচারের আওতায় আনা গেল না। দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ হলো না। পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হলো না। এখনো অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো না। আইনের শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হলো না। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই বন্ধ হলো না। দুর্নীতি, ঘুস, চাঁদা, হত্যা-খুন-ধর্ষণ বন্ধ হলো না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমানো সম্ভব হলো না।

মানুষের আয় বাড়ল না। শ্রমিকের ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত হলো না। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হলো না। ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলো না। জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেল না। মানবাধিকার রক্ষা হলো না। নিরাপদ পানি ও খাদ্যের নিশ্চয়তা হলো না। পরিবেশ দূষণ রোধ করা গেল না। ময়লা-আর্বজনার শহর সুন্দর হলো না। মানুষের ব্যবহার পালটানো গেল না। তাহলে সংস্কার বলতে কী হলো-জনাব প্রফেসর ড. ইউনূস সাহেব?

‘সংস্কার’ শব্দটি দিয়ে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর সমাধান যদি না হয়, তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়-সংস্কার আসলে কতটুকু কার্যকর? পাহাড় সমান ব্যর্থতা নিয়ে সংস্কার নামে গল্প শুনিয়ে আর কত দিন?

র‌্যাব, পুলিশ ও আনসারের বদলি বা শুধু পোশাক সংস্কার? কর্মস্থল বদলি বা পোশাক বদলালে কি মানুষের চরিত্র বদলায়? যদি তা সম্ভব হতো, তবে শুধু পোশাক বদলেই রাষ্ট্র বা সমাজের সবার চরিত্র পরিবর্তন করা যেত। কিন্তু চরিত্র তো কোনো বাহ্যিক আবরণ নয়, এটি মানুষের চিন্তাচেতনায় নিহিত। তাই পোশাক বদলালে বাহ্যিক চেহারা পালটায় বটে, কিন্তু চরিত্রের আসল রূপ থেকে যায় অপরিবর্তিত।

গণ-অভ্যুত্থানের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। শিক্ষার্থী, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণির মানুষ তখন একত্রিত হয়েছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজের প্রত্যাশায়। বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণ হয়নি। তবে দুঃখজনকভাবে সেই চেতনা ও লক্ষ্য আজ ব্যাহত হয়েছে।

ছয় মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। মাজারে হামলা, হত্যা, খুন এবং ধর্ষণের মতো অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অদক্ষতা এবং সরকারের দুর্বল নেতৃত্বই মূল কারণ, যার ফলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সরকারের অদক্ষতা ও অবহেলায় দেশের শান্তি এবং সামাজিক শৃঙ্খলাকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়েছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারি এবং মুনাফাখোর সিন্ডিকেটের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্য সরকারের ব্যর্থতার বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাল, ডাল, তেল এবং অন্যান্য মৌলিক খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সরকার বারবার মূল্য নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে গরিব-দুঃখী, সাধারণ মানুষ, বিশেষত নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। অন্যদিকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে।

প্রফেসর ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি অনস্বীকার্য, তবে তার নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বাস্তব দক্ষতা, কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তার সরকারের বর্তমান অবস্থা এক কথায় অকার্যকর-যেখানে পরিকল্পনা নেই, স্বচ্ছতা নেই এবং জনগণের চাহিদার প্রতি কোনো জবাবদিহিতা নেই।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তা ক্রমশ গভীর সংকটের দিকে এগোচ্ছে। দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন উভয়ের কার্যক্রম নিয়েই সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের ব্যর্থতা এবং আন্দোলনের নেতৃত্বের বিভ্রান্তিমূলক অবস্থান-এ দুটি বিষয় বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে; যা নাগরিক হিসাবে আমাদের চিন্তিত করে। কারণ এ সরকার আমাদের অংশীদারত্ব, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশার সরকার।

অন্যদিকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, বিচার বিভাগ সংস্কার, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন সংস্কার এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত সময় দেওয়ার পর আবারও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ছয়টি সংস্কার কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

জনমনে একটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে-একের পর এক সময় অতিবাহিত করার উদ্দেশ্যে কি সরকার আবারও সময় বাড়াল? বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা এ সিদ্ধান্তকে সন্দেহের চোখে দেখছেন; তারা মনে করছেন, এটি সরকারের অঙ্গীকারহীনতা এবং জনগণের দাবি উপেক্ষার প্রতিফলন।

ড. ইউনূস সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, তারা এখনো সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে পারেনি। জনগণ একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা চায়, কিন্তু সরকার শুধু বিভ্রান্তিকর বক্তব্য এবং সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে তাদের হতাশ করছে।

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সময়মতো নির্বাচন; যা জনগণের মতামতকে প্রতিফলিত করে। তবে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ না হওয়ায় বর্তমানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ক্রমাগত বাড়ছে, যা গণতন্ত্র এবং স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর অধিকাংশ নেতার মতে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা উচিত নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হলো জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা এবং নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন গণমানুষের স্বপ্ন এবং প্রত্যাশার প্রতীক। এটি কেবল একটি ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া নয়, বরং জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের উচিত দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। জনগণ তাদের অধিকার প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত-এখন প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগ। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার মাধ্যমে সরকার জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে।

৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ছিল জনগণের একটি নতুন দিনের স্বপ্ন- একটি গণতান্ত্রিক এবং সুশাসনের বাংলাদেশ। কিন্তু আজকের বাস্তবতা সেই স্বপ্নের বিপরীত। ‘সংস্কার’ গল্পের পাঠকশ্রোতা কমে গেছে, ‘নির্বাচন’-এর পাঠকশ্রোতা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ও তারিখ ঘোষণা করা একটি সময়োপযোগী এবং অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হবে।

সাঈদ খান : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক-ডিইউজে

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম