সামাজিক সুরক্ষায় দরকার সুদূরপ্রসারী নীতি
সারা আল মুল্লা
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজকের দ্রুত পরিবর্তিত বিশ্বে পারিবারিক নীতি আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে। যেমন, কর্মজীবনের ভারসাম্য, অর্থনৈতিক চাপ, শিশু যত্নের সুযোগ, যোগ্যতা ও সামাজিক সহায়তার মতো অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালনে পরিবারগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
পরিবার এবং সামাজিক সম্পর্কগুলো একজন ব্যক্তির কল্যাণে ব্যাপক অবদান রাখে; পাশাপাশি তাদের অনেক ব্যক্তিগত ও পেশাদার উচ্চাকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। যদিও আধুনিকতা এ প্রবণতায় পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনের গতিশীলতাকে নতুন আকার দিচ্ছে; যা পরিবার এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোকে সমর্থনের মৌলিক উৎস হিসাবে দেখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, নারীর ক্ষমতায়নে ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণে দেখা গেছে আরও বেশিসংখ্যক নারী কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছেন; এর ফলে পিতামাতাদের সন্তানের যত্নের জন্য সময় দিতে আরও নমনীয় কাজের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
অন্যদিকে, বিবাহ, লিঙ্গ ভূমিকা এবং ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতার পরিবর্তিত প্রত্যাশার কারণে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক যুবক-যুবতী আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে বিয়েতে বিলম্ব করছে এবং পরে পরিবার শুরু করছে, যা কম প্রজনন হারের মতো জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। সব মিলিয়ে এ প্রবণতাগুলো আধুনিক সমাজের ক্রমবর্ধমান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গতিশীলতাকে বিবেচনা করে কার্যকর পারিবারিক নীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর ব্যাপক জোর দিচ্ছে।
গত মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার ‘পরিবারবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে, যাতে সমাজের ভিত মজবুত করতে পরিবারগুলো ভূমিকা রাখে। নতুন মন্ত্রণালয়টিকে প্রজনন হার ও পারিবারিক ভাঙনের মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সমন্বিত পরিবার, ইতিবাচক মূল্যবোধ এবং ভারসাম্যপূর্ণ পারিবারিক বিকাশের লক্ষ্যে নীতিমালা তৈরি ও তা বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়টি পরিবার ও মানুষকে যে কোনো ধরনের অপব্যবহার বা সহিংসতা থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি বিয়েতে সহায়তা, শিশুর লালন-পালনে পিতামাতাকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং কর্ম ও জীবনের ভারসাম্যের মতো কাজগুলো তদারকি করবে। একইসঙ্গে এ মন্ত্রণালয় শিশুদের কল্যাণ, বিশ্বমানের পরিষেবার প্রতিশ্রুতি পূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি অসহায় মানুষ, প্রবীণ নাগরিক ও অনাথদের মতো দুর্বল গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তায় অন্তর্ভুক্ত করার দিকেও মনোনিবেশ করবে।
আধুনিক পরিবারগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে প্রগতিশীল পারিবারিক নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেন উল্লেখযোগ্যভাবে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার নিয়ে গর্ববোধ করে। সে দেশের নীতির ফলে ২৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যক্তি কর্মক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছে; সেখানকার নীতিতে কর্ম ও জীবনের ভারসাম্যের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও তা কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়।
বিশেষত, সুইডেন পিতামাতার ছুটির ক্ষেত্রে উদারনীতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এতে অভিভাবকরা প্রতি সন্তানের জন্য ৪৮০ দিন ছুটির সুযোগ পায়। অন্যদিকে, ফ্রান্স শিশুর যত্নে সাশ্রয়ী মূল্যের পরিষেবা এবং পারিবারিক আয়ের পরিপূরক নীতি সরবরাহ করে। এর ফলে পরিবারগুলোকে আর্থিক সীমাবদ্ধতায় ভুগতে হয় না এবং তাদের কর্মজীবনকেও অনেক সহজ করে দেয়। আবার জার্মানিতে, সন্তানদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর জন্য আয় নির্বিশেষে সব পিতামাতাকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। নরওয়েতেও মাতৃ ও শিশু সেবাসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, অন্যদিকে জাপান তার বিবেচনাশীল নীতির মাধ্যমে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে সমর্থন করার দিকে মনোযোগ দেয়।
উন্নত দেশগুলোর বহুমুখী এসব নীতি পারিবারিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে এবং সুস্থতার হার বাড়াতে যে অনেক উদ্ভাবনী উপায় অনুসরণ করে, তা তুলে ধরে। এমন প্রচুর প্রমাণ রয়েছে, যা পরিবারবান্ধব নীতি ও কর্মসূচির সুবিধাগুলো তুলে ধরে, জীবনের সব পর্যায়ে সুস্থতার সর্বোত্তম স্তর নিশ্চিত করে, পাশাপাশি একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রতিযোগিতামূলক কর্মশক্তি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখে। আসলে একটি স্থিতিশীল এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে পারিবারিক সুস্থতার দিকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ চাকরি, পর্যাপ্ত আয় ও সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করা সহজ হয়।
উপরন্তু, আবাসিক এলাকা কিংবা সামগ্রিকভাবে শহরের কাঠামো তৈরিতেও তা যেন পরিবারবান্ধব হয়, সে ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রতিফলন প্রয়োজন। এর মধ্যে স্কুল, স্বাস্থ্যসেবা, সবুজ স্থান, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, খেলাধুলার সুবিধা, শিশুযত্ন কেন্দ্র, লাইব্রেরিসহ অন্যান্য অনুকূল সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। পাশাপাশি একটি কার্যকর প্রবীণ নীতির প্রয়োজন, যা প্রতিক্রিয়াশীল স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক সহায়তা, আবাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, সুরক্ষা ও সমাজে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করে তাদের সুস্থতা, স্বাধীনতা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করে।
আজ পরিবারগুলো যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা উপশমে পারিবারিক জীবনের নিরন্তর পরিবর্তনশীল গতিশীলতার দিকে গভীর মনোযোগ দেওয়া উচিত। নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রেও বিষয়গুলোকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত, যাতে পরিবারগুলো যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আজ হচ্ছে, তা হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
(গালফ নিউজ থেকে অনূদিত)
সারা আল মুল্লা : আরব আমিরাতের সাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী