নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
সিন্ডিকেটকারীদের ধরা হচ্ছে না কেন?
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
বড় খবর। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এবার সঞ্চয়পত্রে নানা ধরনের পরিবর্তন আনছে। আমরা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে জানি না এসব পরিবর্তন কী। খবরে দেখা যাচ্ছে, সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ হবে। সঞ্চয়পত্র দৃশ্যত দীর্ঘমেয়াদি আমানতের মতো হলেও তা নয়। এর সুদহার বদলানো যায় না। এসব দীর্ঘমেয়াদি ইনস্ট্রুমেন্ট। এফডিআর সবসময় ভাঙানো যায়। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয়পত্রকে আমাদের দেশে সঞ্চয়ের একটা প্রধান আধার বলে ধরা হয়। প্রশ্ন হলো, যে কারণে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, সেই কারণ কতটা বাস্তবায়িত হবে? উদ্দেশ্য, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সরকার এ পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছে বটে; কিন্তু সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই। শোনা যাচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হবে। করুক। কিন্তু বেসরকারি খাতের কী হবে? মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি মজুরি সমানতালে বাড়ে, তাহলে অসুবিধা কী? কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বিগত তিন বছর যাবত যে হারে মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, সেই হারে মজুরি বাড়ছে না। ফলে ৮০ লাখের মতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়েছে। এদের দারিদ্র্যসীমার উপরে তুলতে বহু সময় লাগবে। এদিকে টিসিবির পণ্য বিক্রি অর্ধেক হয়েছে, কার্ড বাতিল হয়েছে। টিসিবি টাকার অভাবে পণ্য আনতে পারছে না। টিসিবির পণ্যে ভর্তুকি আছে। এটা এখন অর্ধেক আছে। একই অবস্থা গ্রামের ১ কোটি পরিবারের। শোনা যাচ্ছে, তাদের কার্ডের সংখ্যাও নাকি কমানো হচ্ছে। এদিকে মূল্যস্ফীতি উচ্চ। সরকারের চেষ্টা তা কমানো। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নেই। চাকরি হারাচ্ছেন অনেকে। মিল-ফ্যাক্টরি বন্ধ হচ্ছে। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, সুদের হার উচ্চ। ডলারের দাম বেশি। তারা বিপদে। এর অর্থ, তারা নতুন কর্মসংস্থান দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না।
আমরা দুর্ভাগা দেশের লোক। অতীতে অনেকবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করেছে। একবারও সফল হয়নি। তবু তারা আসে। আমরা ডেকে আনি। এবার এসেছে মাত্র ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের জন্য। কত পদক্ষেপ তাদের, ফলাফল শূন্য। গত তিন বছর ধরে তারা চেষ্টা করছে। যাই বলছে, তা-ই আমরা করছি। কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়ছে তো বাড়ছেই। তারা দ্বিমুখী একটি প্রতিষ্ঠান। এক মুখে বলে এক কথা, অন্য মুখে আরেক কথা। মুখে বলে মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা, কিন্তু অন্তরে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো। এবার সর্বশেষ তাদের পরামর্শে বছরের শুরুতেই ১০০টি পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়বে মধ্যবিত্তের ওপর। পোশাক, মিষ্টি, বিস্কুট, এলপি গ্যাস থেকে শুরু করে হেন পণ্য নেই, যেগুলোর শুল্ক-ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়নি। এবার বলুন? ধরে নিলাম তারা পণ্ডিত মানুষ, তারা বলছে দ্রব্যমূল্য কমাতে। আবার তারাই পরোক্ষভাবে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। কেন এই দ্বিমুখী আচরণ? বলা হচ্ছে, আমাদের রাজস্ব নেই। রাজস্ব বাড়াতে হবে। ১০০টি পণ্য ও সেবায় রাজস্ব বাড়বে নাকি মাত্র ৩০,০০০ কোটি টাকা। এই যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে, সবাই জানে এরা কারা। এদের বিরুদ্ধে কিছুই করা যাচ্ছে না। অন্তত একটি কাজ তো করা যায়। তাদের ওপর ট্যাক্স বসানো যায় না? এরা কি খাতিরের লোক? আগে তারা খাতিরের লোক ছিল, এখন তো আর নেই। এ সরকারের তো রাজনীতি নেই। রাজস্ব বোর্ডের যে ক্ষমতা, এখানে কেউ বাধা দিতে পারে না। তবু কেন তা হচ্ছে না? প্রতিবছর ট্যাক্স অনাদায়ী থাকে। কোনো বছরই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না, ট্যাক্স আদায় হয় না। এটা চলছে বছরের পর বছর। নতুন করদাতা নেই। ‘টিআইএন’ধারীর সংখ্যা অনেক বাড়ছে। প্রতিবছর বলা হচ্ছে, নতুন ‘টিআইএন’ধারী আসছে। কিন্তু ট্যাক্স কোথায়? জিডিপি বাড়ছে হরদম। কিন্তু ট্যাক্স কোথায়? অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একটি পণ্য ৪-৬ বার বিক্রি হচ্ছে। পুঁজি নেই, লেনদেন নেই, প্রতিযোগিতা নেই। অথচ লাভ করে নিচ্ছে। কোনো ট্যাক্স নেই। গ্রামাঞ্চলে বহু লোক আছে, যারা ট্যাক্স দিতে পারে। সম্পত্তির দাম বাড়ছে। অথচ কোনো ট্যাক্স নেই। মানুষ ফুকুটে লাভ করছে। ট্যাক্স নেই। অহেতুক ট্যাক্স অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। অথচ রাজস্বের অভাব। আর রাজস্বের অপচয় তো আছেই। করার কথা ছিল ট্যাক্স বিভাগকে দুই ভাগ করা-নীতি ও বাস্তবায়ন। আজও হয়নি। করার কথা ছিল, রাজস্ব বিভাগের লোক বসবে রাজস্ব প্রধান হিসাবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। সব জায়গায় বাধা। রাজস্ব নেই, অথচ রাজস্বের অভাবে কিছুই হচ্ছে না। কেউ রাজস্ব দিতে রাজি নয়। ভ্যাট ফাঁকি, কর ফাঁকি ইত্যাদির পাশাপাশি টাকা পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে। কেউ দেশে আসতে চায় না। দেশ ছেড়ে বিদেশে।
ব্যবসা-বাণিজ্য বিদেশে, টাকা-পয়সা বিদেশে। অথচ মুখে মুখে সরকারের ওপর চাপ-বিনিয়োগ নেই। আরে, নিজ দেশের লোক বিনিয়োগ না করলে পরের দেশের লোক বিনিয়োগ করবে কেন? সহজ কথা। দেশে কি বিনিয়োগের পরিবেশ আছে?
এসবের প্রভাব পড়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর। তারা সহজে ঋণ পায় না। তাদের কোথায় কেউ নেই। মুখে মুখে কথা আছে; কিন্তু বাস্তবে নেই। উচ্চ সুদ, ডলারের উচ্চমূল্য, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। এরা চলবে কী করে? এদের বাজার কোথায়? এরা চলে বড়দের ওপর নির্ভর করে। অনেকেই এরা সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। দেশে ৭০-৮০ লাখ ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিট আছে। অথচ এগুলো সর্বক্ষণ চালু রাখার ব্যবস্থা নেই। এখানে লাখ লাখ লোক কাজ করে। তবু চালু রাখার ব্যবস্থা নেই। সবারই নজর বড় বড় কারখানার প্রতি। বড়দের ঋণ দিলে ঝুঁকি কম। আদায়ে অসুবিধা নেই। ছোটদের ঋণ দিলে খরচ বেশি। তাই ছোটদের দিকে নজর দেয় না কেউ। এটা একটা বোঝা। আমাদের নজর মুড়ির ব্যবসা, ছাগলের ব্যবসায়। এতে করে বড় কিছু করা যাবে না। যদি তাই হতো, তাহলে সবাই তা-ই করত। সরকারের উচিত ছোটদের প্রতি নজর দেওয়া। নজর দিন বড় মার্কেটের দিকে। শেয়ারবাজারে।
টাকার হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১০০ পণ্য ও সেবার মাধ্যমে বর্ধিত করে আদায় হবে মাত্র ৩০,০০০ কোটি টাকা। অথচ বিপরীত দেখা যাচ্ছে, ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। পরিসংখ্যানটি করেছেন খ্যাতনামা লোকজন। তারা যেহেতু অর্থ পাচারের ঘটনা উদ্ঘাটন করেছেন, সেহেতু তাদেরকেই তা উদ্ধার করার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। আর অর্থ পাচারকারীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হোক।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়