রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, শত্রু নয়
মো. মুজিবুর রহমান
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কখনোই বিদ্বেষহীন সম্পর্ক ছিল না। দেশে একাধিক বড় রাজনৈতিক দল আছে। অনেক সময় বড় দলের নেতৃত্বে অন্যান্য ছোট দল নিয়ে দলীয় স্বার্থে পৃথক পৃথক জোট গঠন করা হয়ে থাকে। এটা লক্ষ করার বিষয় যে, জোটের বাইরের দলগুলোর সঙ্গে জোটভুক্ত দলগুলোর সম্পর্ক প্রায় সব সময় বৈরীভাবাপন্ন ছিল এবং এখন যে ওই বৈরীভাবাপন্ন সম্পর্কের অবসান হয়েছে, তা নয়। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অসহনশীল আচরণ ও অবিশ্বাসপূর্ণ সম্পর্ক দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলা যেতে পারে, এ সম্পর্ক এখন দেশের সাধারণ মানুষের জন্য নানামুখী মনস্তাত্ত্বিক বিড়ম্বনা এবং রাজনীতির প্রতি এক ধরনের বীতশ্রদ্ধ সৃষ্টি করছে। একইসঙ্গে এ ধরনের বৈরিতার কারণে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক পরিবেশও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের কারও কারও বক্তব্য অনেক সময় সাধারণ ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে যেতে দেখা যায়। কে, কাকে, কত বেশি নিম্নমানের ভাষা ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে পারবেন, তা নিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। রাজনীতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বৈরিতা এখন এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যেসব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কয়েক মাস আগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, সেসব আশা-আকাঙ্ক্ষা বলতে গেলে একরকম চাপা পড়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ, আগামী সাধারণ নির্বাচনই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অথচ শুধু সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানই ওই অভ্যুত্থানের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল না।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কিছু রাজনৈতিক দলকে অন্য দলের উদ্দেশ্যে কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে যেসব ভাষায় আক্রমণ চালিয়ে যেতে দেখা যায়, তাতে দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অসহিষ্ণু ও বৈরী আচরণের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এর ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রায়ই বাকবিতাণ্ডজনিত উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ঘটছে আগামী সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। রাজনৈতিক দলগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে, কখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভোটারের আনুকূল্য পাওয়া এবং নির্বাচনে জয়লাভ করা সবচেয়ে বেশি সহজ হবে, তা নিয়ে। এতে দোষের কিছু নেই। বরং নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ, আলোচনা-পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ চলবে-এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কীভাবে অন্য দলকে পেছনে ফেলে নিজ দলকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া যাবে, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে অবশ্যই। কিন্তু তাই বলে অন্য রাজনৈতিক দলকে উদ্দেশ্য করে নানা ধরনের উত্তপ্ত ভাষায় আক্রমণ চালানো হবে- এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং এ ধরনের কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক, দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থেই তা কাম্য নয়। তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে স্পষ্টতই বোঝা যায়, তারাও এসব ভালোভাবে নেয় না।
আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা দরকার যে, প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধিতা থাকবে, কিন্তু বৈরিতা নয়। তবে কখনো কখনো রাজনৈতিক কারণে কোনো বিষয়ে ভিন্নমত দেখা গেলেও তা হতে হবে দেশের জনগণের স্বার্থে। রাষ্ট্রের যে কোনো রাজনৈতিক সমস্যা রাজপথে আন্দোলনের পরিবর্তে মুখোমুখি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীল ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে মনে করি। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক বৈরিতা তাদেরকে যেন একদল আরেক দলের মহাশত্রুতে পরিণত করে তুলছে। অতীতে দেশের প্রধান দুটি বড় দলের মধ্যে এ সম্পর্ক এতটাই খারাপ দেখা গেছে, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পরস্পর মুখ দেখাদেখিও অনেক সময় হয়ে উঠেনি। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না, হওয়া উচিতও নয়। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হলো, একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যুক্তিসংগত বিরোধিতা যেমন থাকবে, অন্যদিকে যে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন, সেই দলের কার্যক্রম এবং সরকার পরিচালনায় ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে সমালোচনা করা এবং সেসব জনগণকে অবহিত করার অধিকারও ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর থাকবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিরোধী দলকে ছায়া সরকার হিসাবে অভিহিত করা হয়। জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে নানা ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করা বিরোধী দলের দায়িত্ব ও অধিকারের মধ্যে পড়ে। সরকারি দলের দায়িত্ব বিরোধী দলের রাজনৈতিক মর্যাদা সমুন্নত রাখা। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের সৃষ্টি হওয়া এখন এক ধরনের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। একদল আরেক দলকে যে ধরনের ভাষায় আক্রমণ করে, তা কোনো উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অকল্পনীয় ব্যাপার। এ ধরনের অকল্পনীয় ব্যাপারই দেশে ঘটে চলেছে অবলীলায়। বলা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, শত্রু ভাবছে সব সময়। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতির পরিবর্তন দেশ ও জনগণের স্বার্থেই জরুরি।
স্মরণ করা যেতে পারে, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তার দায়িত্ব পালনকালীন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান শেষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক বিদায়ি ভাষণে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমার একটি বিশেষ আবেদন রইল। নতুন জাতীয় সংসদকে কেন্দ্র করে আপনারা এমন রাজনৈতিক রীতি-রেওয়াজ গড়ে তুলুন, যেন ভবিষ্যতে আর কোনোদিন রাজনৈতিক কোনো সমস্যা সমাধানে রাজপথের আশ্রয় নিতে না হয়। কিছুদিন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সীমাহীন অসহিষ্ণুতা দেখেছি, ভবিষ্যতে যেন আর কাউকে অসহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখতে না হয়, তার প্রক্রিয়া সৃষ্টি করুন।’ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ওই আবেদন কতটুকু বিবেচিত হয়েছে, কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো কর্র্তৃক কতটুকু সমাদৃত আর কতটুকু অনুসৃত হয়েছে, তা আর নতুন করে বলার দরকার পড়ে না; বাস্তব পরিস্থিতিই এসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। বরং আমরা দেখছি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্য দলগুলো সব সময়ই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য আলোচনার পরিবর্তে রাজপথকে বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলও সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে তাদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও দমানোর লক্ষ্যে নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগ করছে। দরকার হলে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও নির্দ্বিধায় বিরোধী রাজনৈতিক দল ও মত দমনে ব্যবহার করতে দ্বিধা করছে না। এছাড়া সরকারি ক্ষমতার বলয়ে থেকে বিরোধী মত দমনে নানাভাবে হামলা-মামলার ঘটনা তো ঘটিয়েই থাকে। এর সবকিছুকেই রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অসহিষ্ণুতার প্রকাশ হিসাবে ধরে নিতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি কখনোই গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক নয়।
দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ধরনের বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করতে দেখা যায়, তা নতুন প্রজন্মসহ আগামী দিনগুলোয় যারা রাজনীতিতে আসবে, তাদের জন্য কী বার্তা দেবে, সেটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বলে মনে করি। রাজনৈতিক দলগুলো যতদিন পর্যন্ত পরস্পর পরস্পরকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে শত্রু ভাববে, ততদিন পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র সুসংহত হবে না। দেশে সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অসহিষ্ণু আচরণের পরিবর্তন করতে হবে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে। দেশের জনগণের প্রতি আস্থা রাখতে হবে সব সময়। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল শুধু সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব। এর মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, জনগণই রাষ্ট্রীয় সব ক্ষমতার উৎস। কিন্তু এ দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার পালাবদল খুব কমই হয়েছে। এর আরেক কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এ ধরনের পরিস্থিতির পরিবর্তন জরুরি।
মো. মুজিবুর রহমান : অধ্যাপক ও সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com