সাইবার সুরক্ষা আইন জনগণকে কতটা সুরক্ষা দেবে?
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![সাইবার সুরক্ষা আইন জনগণকে কতটা সুরক্ষা দেবে?](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/01/11/Untitled-67819c4db163f.jpg)
স্বৈরশাসকদের সবচেয়ে বড় ভয় নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়। স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করতে হলে প্রথমেই নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করতে হয়। দু’ভাবে স্বৈরাচারী সরকার নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করে-বলপ্রয়োগ ও আইন প্রয়োগ। বিগত সরকার এ দু’ভাবেই নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। সরকার একের পর এক কঠিন কঠিন আইন করে মতপ্রকাশের পথ সংকীর্ণ করেছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনী সেই আইনের প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ করে সেই পথকে আরও সংকীর্ণ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার সিকিউরিটি আইন ইত্যাদি নানা কঠিন আইনি মারপ্যাঁচে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নানাভাবে খর্ব করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের ‘শান্তি ভঙ্গ’ ও ‘নিরাপত্তা বিঘ্নিত’ হওয়ার অজুহাতে মূলত সরকারবিরোধী মতামতকে দমন করা হয়েছে। এর সঙ্গে গত এক দশকে যোগ হয়েছে আরও কয়েকটি শব্দগুচ্ছ, যার মাধ্যমে জনগণের স্বাধীন মতামত প্রকাশের পথ পুরোপুরি রুদ্ধ করা হয়। বিগত সরকার ২০২৩ সালে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামে একটি আইন করে, যেটি ছিল মূলত নতুন মোড়কে পুরোনো আইন। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নাম বাদ দিয়ে নতুন নামে এ আইনটি করে। কিন্তু নতুন আইনে নিবর্তনমূলক বিধানগুলো ঠিকই রয়ে যায়। আইনি ও পুলিশি হয়রানি বন্ধ হয় না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ফলে পুরোনো কালো আইনগুলো বাতিলের প্রসঙ্গটি আবার সামনে চলে আসে। সরকার ইতোমধ্যে আগের সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করেছে। কিন্তু আইনটি বাতিল করলেও সাইবার নিরাপত্তা বা সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৪-এর একটি খসড়া অনুমোদন করেছে।
সরকার আইনের খসড়া থেকে আগের বিতর্কিত আইনের বেশ কয়েকটি ধারা বাদ দিয়েছে। অর্থাৎ নতুন আইনে আগের আইনের কয়েকটি ধারা আনা হয়নি। যেহেতু আগের পুরো আইনটিই বাদ দেওয়া হয়েছে, তাই সংগত কারণেই ওই আইনের অধীনে করা মামলাগুলো বাতিল হয়ে যাবে। সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মামলার রায়ে প্রদত্ত দণ্ড ও জরিমানাও বাতিল হবে। অনেক বিরোধী নেতাকর্মী হয়রানিমূলক মামলা থেকে অব্যাহতি পাবেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার সিকিউরিটি আইনের অনেক মামলাই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রারি করার জন্য করা হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস বা মন্তব্য বা ছবির ওপর ভিত্তি করে এসব হয়রানিমূলক মামলা করা হয়। সব মামলা যে সরকারই করেছে তা নয়, স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা অন্যান্য স্থানীয় নেতাও এসব মামলা করেছেন। আবার স্থানীয় শত্রুতার বশেও একে অপরের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা করেছে।
আগের আইন দুটি (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং সাইবার সিকিউরিটি আইন ২০২৩) প্রণয়নের আগেই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এ আইনের অপব্যবহার হবে। বাস্তবেও তা-ই হয়েছে। এর অপব্যবহার রোধ করা যায়নি। ফেসবুকে সামান্য স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে অনেক শিশু বা নাবালকের বিরুদ্ধেও এমন মামলা করা হয়েছে। অনেক মামলা এখনো হয়তো বিচারাধীন আছে। আবার অনেকে জেল খেটেছেন, জরিমানা গুনেছেন। এ আইনের মাধ্যমে বিগত সরকার বিরোধী মত দমনের সর্বোচ্চ সুযোগ পেয়েছে। সেই সঙ্গে ছিল পুলিশের মামলা বাণিজ্য। প্রতিপক্ষের ছিল হয়রানি বাণিজ্য।
আগের আইনে শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রের ‘শান্তি ভঙ্গ’ ও ‘নিরাপত্তা বিঘ্নিত’ হওয়ার অজুহাতে বিরোধী মত দমন করত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার সিকিউরিটি আইনে আরও ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘জাতীয় সঙ্গীত’ বা ‘জাতীয় পতাকা’ সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ড। এসব শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেরই নয়, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধেরও চেষ্টা করা হয়েছে। মূলত এ বিষয়গুলোর সঙ্গে আমাদের জাতিগত আবেগ-অনুভূতি ও ইতিহাস সংশ্লিষ্ট। কিন্তু আইনে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকায় এর অপপ্রয়োগের সুযোগ ছিল। আইনে এ বিষয়গুলো সংজ্ঞায়িত ছিল না। ফলে এর রাজনৈতিক ব্যবহার হয়েছে। নতুন আইনে এ বিষয়গুলো নেই; তাই অপব্যবহারের আশঙ্কাও নেই।
আগের আইনে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ বা প্রকাশ করলে সেটিকে অপরাধ বিবেচনা করা হতো। নতুন সাইবার সুরক্ষা আইনে এ সংশ্লিষ্ট ধারাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি যৌক্তিক। কার কাছে কোন বিষয় আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক-এ বিষয়গুলো আপেক্ষিক; তাই অপব্যবহারের সুযোগ ছিল। এছাড়া কোন তথ্যে কে বিরক্ত, অপদস্ত বা হেয় প্রতিপন্ন হবেন, সেটিও আপেক্ষিক। এ ধারার অপব্যবহার করে অনেকে হয়রানিমলূক মিথ্যা মামলা করত। সরকারের সমালোচনা করলেও তাকে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন বলে চালিয়ে দেওয়া হতো। এগুলো ছিল স্বৈরাচারের হাতিয়ার।
এছাড়া ২৯ ও ৩১ ধারায় মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো বিষয়ক ধারাটিও বাদ দেওয়া হয়েছে। ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে কোনো মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করলে ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। তথাকথিত মানহানির জুজুর ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। এ ধারা বাদ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল।
মানহানির অভিযোগে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করে মূলত স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। অতীতে সব সরকারই এ কাজটি করেছে। যখন সাইবার সিকিউরিটি আইন ছিল না, তখন দণ্ডবিধির মানহানির ধারায় সাংবাদিকদের আটকে দেওয়া হতো। এরপর যোগ হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং এর পরে সাইবার সিকিউরিটি আইন। তাই বর্তমান সরকার বাস্তব কারণেই তথাকথিত মানহানিকর এ ধারা নতুন আইনে সংযুক্ত করেনি। বর্তমানে সাইবার বুলিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে নারীরাই বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। নতুন আইনে এসব প্রতিরোধ করার সুযোগ আছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন মতপ্রকাশের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সমাজের সর্বস্তরের নাগরিকরা এ মাধ্যমেই তাদের মতপ্রকাশ করে থাকে। কিন্তু গত এক দশক ধরে সব মাধ্যমেই নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকীর্ণ করা হয়। আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারছে। গণমাধ্যমের ওপর খবরদারি নেই। সরকারি কোনো চাপের মুখে পড়ে বা পুলিশের মামলার ভয়ে কেউ মতপ্রকাশে বিরত নেই। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এখন নানা অপরাধেরও প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। বর্তমানে অনলাইনে জুয়া খেলা চলছে বেশুমার। আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে সরকারকে অনলাইনে নজরদারি বাড়াতে হবে। সে কারণেই নতুন অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসে জুয়া খেলাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অনলাইনে জুয়া খেলা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে।
ডিজিটাল এ যুগে নাগরিকদের সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। নারী ও শিশুদের জন্য অনলাইন সেফটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। নিরাপদ অনলাইন দুনিয়া সব নাগরিকের জন্যই জরুরি। বর্তমান জীবনই অনলাইন জীবন। অনলাইন ছাড়া যাপিত জীবন কল্পনা করাও কঠিন। এটি আসলে এখন মৌলিক চাহিদার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রকে নাগরিকদের এ অনলাইন চাহিদা মেটাতে হবে এটি যেমন সত্য, তেমনি এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি। নাগরিকদের জন্য ইন্টারনেটপ্রাপ্তি আরও সহজলভ্য করতে হবে। একইসঙ্গে অনলাইন নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে।
সাইবার সুরক্ষা একটি জরুরি বিষয়। নাগরিকের মত প্রকাশ বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বাইরেও এ আইনের প্রাসঙ্গিকতা আরও ব্যাপক। শুধু গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটেই আইনটিকে বিবেচনা করলে হবে না; নাগরিকের তথ্য, গোপনীয়তা রক্ষা করাও এ আইনের উদ্দেশ্য। এ ছাড়া নাগরিকদের অনলাইন হয়রানি থেকে রক্ষা করাও এ আইনের উদ্দেশ্য।
নাগরিকদের সাইবার সুরক্ষা দিতে এ আইনে জাতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন করার কথা বলা আছে। মূলত নাগরিকদের সাইবার সুরক্ষা দিতে হলে আইনের মাধ্যমে রেসপন্স টিম গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। শুধু বিরোধী মত দমনের জন্য পুলিশি হয়রানি বা মামলা করে নাগরিকদের ঘরবাড়ি ছাড়া করা এ আইনের উদ্দেশ্য নয়; নাগরিকদের সাইবার সুরক্ষা দিতে ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম কাজ করবে, যে টিমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও থাকবে। এ টিম জরুরি ইন্টারনেট পরিকাঠামো রক্ষা করবে, ডিজিটাল হামলা প্রতিরোধ করবে; আইনে এটি ভালো উদ্যোগ।
অপরাধীরা এখন ডিজিটাল মাধ্যমে সক্রিয়। সরকার এ আইনের মাধ্যমে সব ধরনের ডিজিটাল অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। আইনে সে সুযোগ আছে। আইনের পরিধি সে কারণেই অনেক ব্যাপক। আইনানুযায়ী যে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের কথা বলা আছে, তার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আইনটির ২২ নং ধারায় সাইবার সন্ত্রাসের ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক। তাই এ ধারার অপব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এ ধারার পরিসর ব্যাপক থাকাই যৌক্তিক। সমস্যা হলো, রাজনৈতিক সরকারগুলো এ ধারার অপপ্রয়োগ করে বিরোধী মতকে দমন করার চেষ্টা করে। কিন্তু অপব্যবহারের অজুহাতে এ ধারা বাদও দেওয়া যাবে না। অথবা এর প্রয়োগক্ষেত্র সংক্ষিপ্ত করারও সুযোগ নেই। তাই অপপ্রয়োগ রোধে রাজনৈতিক সরকারগুলোর সদিচ্ছা এখানে জরুরি।
মূলত কোনো আইনই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। বাস্তব কারণেই আইনে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। এগুলো মূলত আইনের ত্রুটি নয়, বরং প্রয়োগজনিত চ্যালেঞ্জ। এগুলোকেই আমরা আইনের ত্রুটি বলে অভিহিত করি। এসব ত্রুটি আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই দূর করা যায়।
বাস্তবতা হলো, একটি ভালো আইনের মাধ্যমেও মানুষকে হয়রানি করা যায়। আবার ভালো আইনের মাধ্যমেও অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায় না। আইন প্রয়োগের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের উদ্দেশ্য ও সংশ্লিষ্টতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্বও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে হয়রানি করার মানসিকতা থাকলে ভালো আইন দিয়েও তা করা সম্ভব। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আরও বেশি জরুরি। আইন যদি হয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হাতিয়ার, তাহলে সে আইন দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কীভাবে সম্ভব? তাই আইন হোক মজলুমের সুরক্ষা কবচ, জালিমের হাতিয়ার নয়।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক